পাখি জানলার পাশে পেয়ারা গাছটায় এসে বসল। নির্ভার।
পরেরদিন ভোরে দেখলাম নয়নতারা গাছে, বেশি না, সাত-আটটা নয়নতারা ফুটেছে। নির্ভার।
সেদিন বিকেলে ঝড় উঠল। পাখিটা কি করে জানি ঢুকে পড়ল। ঢুকেই চঞ্চল হয়ে উঠল। একবার দেওয়ালে ধাক্কা মারে, একবার আলমারিতে, একবার থেমে থাকা পাখার ব্লেডে।
ঝড় থামল। সব জানলা-দরজা খুলে দিলাম। উড়ে গেল। পরেরদিন আবার তাকে দেখলাম পেঁপেগাছটার ডালে। নির্ভার। বাগানে নয়নতারাগুলো ঝড়ে পড়ে মাটিতে। গাছটাও নুইয়ে গেছে। তাকে সোজা করে বসিয়ে ঘরে এলাম।
গোটা সংসারে সবাই লাভে-ক্ষতিতে এমন নির্ভার চলছে। আমি পারি না কেন? কেন আমার দিনরাত্রি নিজেরই বোনা হাজার চিন্তার জালে অবসন্ন হয়ে থাকে? কেন আমার বুদ্ধি রাস্তা খুঁজে পায় না? পেলেও মুহূর্তে আবার কুয়াশায় ঢেকে যায়?
দেখতে দেখতে পঁচিশে বৈশাখ এলো। ঘুম ভাঙল, মন বলল, আজ পঁচিশে বৈশাখ।
কি হল? যেন ঝড় থেমে যাওয়ার পর পাখিটার মত আমায় কেউ বাইরে ছেড়ে দিল, সবক'টা দরজা-জানলা খুলে। নির্ভার হলাম।
নির্ভার হওয়ার তৃষ্ণা তো আদিম তৃষ্ণা। সুখে স্পৃহাহীন আর দু:খে উদ্বেগহীন হওয়ার কথা যখন গীতা বলে, তখন শুনলে মনে হয় কি অসম্ভব একটা কথা! কিন্তু আদতে সে নির্ভার হওয়ার কথাই বলছে। কিন্তু পারি না যে! সময়ে দরজাটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতে পারি না। ঘর রোজ ঝাঁট না দিলে হয় না, শৌচাগারে গুমোট নিকাশি পাখা না হলে হয় না, কিন্তু নিজেরই হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কথা ভাবনাতেই আসে না।
পঁচিশে বৈশাখ পারে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও পারে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, রোজ সকালে নিজের ছোটো আমিটাকে বড় আমি'র পায়ে সমর্পণ করি, এই আমার সাধনা।
আর আমি বড় আমি'র হাত থেকে নানা অপযুক্তিতে ছোটো আমিকে বাঁচিয়ে, হাতের মুঠোয় যা আসে তাই জমিয়ে সুখে থাকার ফন্দি আঁটছি। "যাহা রেখেছি তাহে কি সুখ, তাহে কেঁদে মরি, তাহে ভেবে মরি"। আমার বুদ্ধি, মন, শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুকে ছোটো আমি'র কাজে লাগিয়েছি। যেন বুদ্ধিবোধকে বনসাই করেছি। সে নিজের বনসাই অবস্থাকে এমন খাঁটি চিরকালের ব্যবস্থা জেনেছে সে বড়সড় গাছ দেখলেই সন্দেহের চোখে তাকায়। ভাবে জগতজোড়া মস্ত একটা ফাঁকি তার সামনে সেজে বসেছে। সে তাকে ব্যঙ্গ করে, ক্ষতবিক্ষত করে, লক্ষ দোষ বার করে, কিন্তু নির্ভার হয়ে শান্ত হতে পারে না।
পঁচিশে বৈশাখ বলে, বনসাই মিথ্যা বলছি না, কিন্তু এর বাইরে আরেকটা বড় সত্যি আছে। তোমার মধ্যে নির্ভার হওয়ার শক্তি। 'নির্ভার হব' বললেই কি নির্ভার হওয়া যায়? চারদিকের জানলা-দরজা খুলে দিলেই সে আপনি হয়ে যায়।
এর জন্যেই পঁচিশে বৈশাখের বারবার আসা। রবীন্দ্রনাথের দরকারে না। আমার দরকারে।