সৌরভ ভট্টাচার্য
19 July 2020
-- আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ অবসর সময়ে না হয় লেখালেখি করতেন, বাকি সময়টায় কি করতেন?
-- কেন সেরেস্তায় বসতেন... জমিদারির হিসাব-টিসাব দেখতেন... বাপ-ঠাকুর্দার জমিদারি, নইলে সব বারোভূতে লুটেপুটে খাবে না?
-- নোবেল কোন্ বইটার জন্য... ওহো গীতাঞ্জলি... তা এই বইটাই কেন সাহেবদের এত ভালো লাগল?
-- তা লাগবে না... সেই সময়ে মানুষের মনে ভক্তিভাব-টাব ছিল, এমন ভক্তিগীতি ওদের মন জুড়িয়ে গেল পড়ে... তাই একটা পুণ্যের কাজ করতে কার না সাধ যায়...
-- তা আমাদের রামপ্রসাদ, লালন, কমলাকান্ত, জয়দেব, গোবিন্দদাস... এদের দিল না কেন? ওদের ভক্তিগীতিগুলো কি ফেলনার?
-- আহা তা কেন... ফেলনা হতে যাবে কেন? কিন্তু ওরা তো আর ইংরাজিতে লেখেনি ওগুলো... কেন আমাদের পাড়ার বিজয়দা... ওনার লেখা কালীভক্তির গানগুলো... আহা... শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়...
-- তাই? তা শোনাও দেখি একটা পদ...
-- মাগো আমার মনটা যে হল বাসি পান্তুয়া গো মা
আমার চিন্তা হল ছানা, রস হল অনুভব
তায় কামে ভাজা, লোভে চপচপ...
আমার চিন্তা হল ছানা, রস হল অনুভব
তায় কামে ভাজা, লোভে চপচপ...
-- আহা... কি পদ... কি পদ.... এমন লেখা ইংরাজি করে একটা ফর্মে ভরে দিলে হয় না নোবেল দেওয়ার অফিসে?
-- সে দিলেই হয়... কিন্তু উনি ভীষণ প্রচারবিমুখ তো... আমরা কত করে বলি দাদা এগুলো ইংরাজি করো... আমি করতাম... কিন্তু ও পান্তুয়া-টান্তুয়ার ইংরাজি করা কি আমার সাধ্যি বলো?
-- তাও ঠিক।
-- দাদা তুমি কি আর চা নেবে?
-- দিতে বল, বাড়ি গিয়েই বা এখন কি করব? যা বৃষ্টি শুরু হল, এমনিতেও যাওয়া যাবে না... তার চাইতে তোমার সাথে কথা বললে অনেক কিছু জানা যায়, এই যেমন ধরো এই বিজয়বাবুর কথা... এমন একজন ভক্ত মানুষ, আমাদের এই সময়ে ভাবা যায়? রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, প্রেমিক ইত্যাদি কোনো পদকর্তার থেকে কম? কি উপমা...! মন হল গিয়ে ছানা, আর অনুভব হল রস... লোভে ভাজা হয়ে কামে চপচপ...
-- উঁহু, একটু ভুল হল দাদা... কামে ভাজা হয়ে লোভে চপচপ... আসলে অনেক গভীর অর্থ... ওরে এবার লাল চা-ই দে... দুধ বেশি খেলে অম্বল হয়...
-- তা বটে... আমার তো বেশি দুধে পাদে বিশ্রী গন্ধও হয়...
-- সে পাদের কথা থাক দাদা... মায়ের কথা হচ্ছিল... কথাটা ভেবে দেখুন, কেন উনি লিখলেন কামে ভাজা... কারণ কাম মানে তাপ...
-- সে আর বলতে... গরম... নীচ থেকে ভাপ ওঠে...
-- আদিরসের কথা থাক দাদা আজ... মায়ের কথা হচ্ছে... তা যা বলছিলাম... কামের তাপে ভাজা... আর লোভ কেমন? না আঠার মত... মানে কিনা চপচপে... বুঝলেন কিনা... রুমাল আছে?
-- আছে দাদা কেন?
-- আমার চোখে জল এসেছে... আমিও রুমাল এনেছি, কিন্তু আজ আমাদের আমিষ রান্না হয়েছে... একটু আগে ঢেকুর তুললাম মনে হল পাঁঠাটা ডেকে উঠল... মা বলে... আমি আমার রুমালটা দিয়ে মুখ মুছলাম... ওটা এঁটো হয়ে গেল... আর চোখে জল এল মায়ের পদ শুনে, এতো শুদ্ধ জল, একি আমিষের রুমালে মোছা যায় দাদা?
-- ছি ছি... আমি দিচ্ছি, এই নিন... আসলে আমাদের এই নিরামিষ খাওয়াটা একেবারে বংশগত... আমার ঠাকুর্দার বাবার বাবা ছিলেন আকবরের সেরেস্তার নায়েব...
-- রুমালটা দিন... দিতে দিতে বলুন... ঝাপসা দেখছি যে...
-- ও হ্যা... এই নিন... তা তিনি একবার আকবরের সাথে কথা বলে বাড়ি ফিরছেন হঠাৎ দেখেন রাস্তায় একটা ছাগল... তাকে দেখেই গেয়ে উঠল... "একি এ ঘোর বন এনু কোথা... পথ যে জানি নে... মোরে দেখায়ে দেনা... কি করি এ আঁধার রাতে......"
-- আহা... কিন্তু সুরটা যেন খুব চেনা চেনা... কথাগুলোও... কোথায় যেন শুনেছি...
-- আমিই হয় তো আগে বলেছি দাদা... এই গল্প আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য... আমার বাবাও এই উপাখ্যান শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করলেন... তা যা বলছিলাম... উনি ছাগলটাকে দেখে তো ভারি খুশী... আসলে ওনার স্বভাব ছিল ছাগলের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট না বানালে উনি খাবেন না... সেই অমন ছাগলবিলাসী মানুষের সামনে যদি একটা আস্ত ছাগল চলে আসে...
-- চা’টা নিন...
-- হ্যাঁ চা, তা উনি সে ছাগল নিয়ে তো বাড়ির দিকে রওনা দিলেন... মনটা খুশীতে ভরপুর... উনি নাকি মুখে মুখে গান বাঁধতে পারতেন... তাই গাইতে গাইতে যাচ্ছেন... "দেখো ও গিন্নী ছাগল এনেছি দেখো... এমন সরস মছলি গিন্নী সহজে না পড়ে ধরা"...
-- আহা, এ গানটাও যে বড্ড চেনা চেনা গো... কথাগুলো যেন কিরকম জানা জানা ছন্দে...
-- তা দাদা আমি ছাড়া আর কার মুখেই বা শুনবেন...
-- তা হবে, তারপর?
-- আর তারপর... উনি তো বাড়ি ফেরার পথে কসাইকে সাথে করে এনেছেন... কিন্তু যেই না কাটতে যাবে... হঠাৎ শোনেন ছাগলটা গেয়ে উঠছে... "দয়া করো অনাথারে... কে কোথায় আছ... বন্ধনে অবশ তনু জরজর ব্যথায়"...
-- ও দাদা, এ গানও আমি শুনেছি যে...
-- উফ্..., বড্ড জ্বালালেন দেখছি... হতে পারে, আমার ঠাকুর্দার এক জ্যাঠতুতো দাদা এই গল্পটা রবিকে ছোটোবেলায় শুনিয়েছিল... টিউশন পড়াতে যেত তো..... পরে রবি তার ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকে এই সব গানের এ পাশ ও পাশ করে কিছু ঢুকিয়ে দেয়...
-- রবি?...
-- আরে রবীন্দ্রনাথ...
-- ও আচ্ছা... তারপর?
-- তারপর কি বলব মশায়... সেই ছাগল হঠাৎ রাত্তিরের অন্ধকারে এক মহাপুরুষ হয়ে গেলেন.. সে নাকি তেইশ হাত লম্বা অগ্নিবর্ণ শরীর.... তিনি মেঘমন্দ্রিত কন্ঠে বললেন, “রে পাষণ্ড... প্রাণীতে প্রাণীতে ঈশ্বর, জানিস না মূর্খ... আজ থেকে যদি নিরামিষ না খাবি তোরা সবশুদ্ধ পাঁঠা হয়ে জন্মাবি এরপর থেকে”... ব্যস... সেই থেকে আমাদের বংশে সবাই নিরামিষ...
-- ওহো... এই নিন আপনার নিরামিষ রুমাল...
-- দিন... তা আরেকটা কথা বলি, এই যে নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত কেউ নোবেল পেলেন না... এর কারণ কি? ওদের গানে কি ভক্তি কম পড়েছিল... কিন্তু ওনারা তো ভালোই ইংরাজি জানতেন... নাকি ঠাকুরবাড়ির কোনো কোটা সিস্টেম ছিল... হতেও পারে ওনার বাপ-ঠাকুর্দা তো খুব বিলেত যেতেন শুনেছি....
-- কথাটা আমিও অনেবার ভেবেছি বুঝলেন... তারপর যেটা নেট ঘেঁটে জেনেছি সেটা হল সেই বছর একমাত্র ‘গীতাঞ্জলি’ যে লিখবে তাকেই দেওয়া হবে আগে থেকেই স্থির হয়েছিল... কেউ তেমন ভালো গীতাঞ্জলি লিখতে পারেননি... তাই... তাছাড়া সেদিনের কথা ছাড়ুন... রবীন্দ্রনাথ চলে যাওয়ার এদ্দিন পরেও কেউ একটাও রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পেরেছে ঠিকঠাক? মাঝে নচিকেতা না কে জানি লিখেছিল... চলে নি... আসলে রক্ত দাদা... রক্ত...
-- আহা আপনি আবার আমিষে কথা বলছেন কেন?
-- আহা সেই রক্ত না, বংশের ধারা বলছি, তার একটা জোর আছে না... সেই জোর কার আছে বলুন... চলুন ওঠা যাক নাকি...? বৃষ্টিটা ধরেছে...
-- চলুন... এমনিতেও হাগা হাগা পাচ্ছে...
-- উফ্..., আপনি রবীন্দ্রনাথের টিউটরের বংশধর হয়ে এমন ম্লেচ্ছ ভাষায় কথা বলেন কেন?
-- ওই যে রক্ত দাদা... পাঁঠায় মহাপুরুষ হত সে যুগে... এ যুগে মহাপুরুষেরা পাঁঠা হয়ে যায় দাদা...
-- হা হা হা হা...
-- হো হো হো হো...