Skip to main content

ছোটোবেলায় একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটা খুব ক্লিশে হলেও আরেকবার বলতে ক্ষতি কি আছে?

    একজন লোক সে শহরে এক ধনীর বাড়ি কাজ পেয়ে গ্রাম থেকে চলে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে সে গ্রামে ফিরে আসে, আর এসেই বলে, এই তোমাদের রাস্তা? এই তোমাদের হাস্পাতাল? এই তোমাদের স্কুল? এই তোমাদের পঞ্চায়েত? এই তোমাদের শিল্প? এই তোমাদের সততা? ইত্যাদি, ইত্যাদি। 

    তো গ্রামের বেশিরভাগ লোকেই কিছু বলে না তাকে। আবার কেউ কেউ মৃদু প্রতিবাদ করে। কিন্তু বেশিরভাগ লোকই সে নিন্দুকের শহুরে পোশাক, অনুকরণ করা আচার ব্যবহারে মুগ্ধ হয় না বলে সে নিন্দুক যায় আরো আরো রেগে। 

    একবার সে থাকতে না পেরে গ্রামের যে বৃদ্ধতম মানুষ তার কাছে যায়। সে জানে একে যদি সে প্রভাবিত করতে পারে তার চিন্তায় তবে গ্রামে তার একটা মান তৈরি হবে। 

    আমাদের গল্পটা যেহেতু উত্তর ভারতের অবাঙালি অঞ্চলের, তাই সে গল্প অনুযায়ী সে নিন্দুক যখন সেজেগুজে সে বৃদ্ধের সামনে এসে বসেছে তখন তিনি, মানে সেই বৃদ্ধ, সদ্য রামচরিতমানস পাঠ করে মন্দিরের চাতালে এসে বসেছেন। 

    নিন্দুক যথারীতি গ্রামের সব কিছুর সঙ্গে শহরের এটা-সেটা তুলনা করে বলল, আপনারও কি তাই মত নয়?

    তখন সে বৃদ্ধ বললেন, দেখো, প্রথমত শহর আর গ্রামের তুলনা হয় না। কারণ তাদের অতীত আলাদা, আদর্শ আলাদা, প্রথা আলাদা, জীবিকা আলাদা, রোগভোগ, বিশ্বাস, আইন কানুন সব আলাদা। তাই বলছিলাম এই তুলনা তো মূলেই অসিদ্ধ। 

    নিন্দুক মনে মনে ভীষণ রেগে গেল। সে নিজের শহুরে দামী পোশাক, তার সে শহুরে মালিকের বাড়িতে নিজের ঘরের বর্ণনা, নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলতে বলতে বৃদ্ধের সাধারণ ঘর, সাদাসিধা পোশাকের দিকে কটাক্ষ করে বলল, এটুকু তো মানেন যে আপনি আমার থেকে অনেক কিছুতে বঞ্চিত আছেন?

    বৃদ্ধ বলল, মানি। কিন্তু তাতে আমার লজ্জা নেই। বরং তুমি যে এতে হীনতা দেখছ বাবা এতেই তোমার লজ্জা পাওয়া উচিৎ। 

    নিন্দুক আরো রেগেমেগে জিজ্ঞাসা করল, কেন? আমার কি গর্ব হওয়া উচিৎ না এত সুযোগ সুবিধার মধ্যে থাকতে পারছি বলে? অন্তত আপনাদের মত পিছিয়ে পড়া মানুষদের থেকে?

    বৃদ্ধ হেসে বললেন, না বাবা। যে আমের গাছ তুমি নিজে লাগাওনি, নিজে পরিচর্যা করোনি, পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচাওনি, সার দাওনি, জল দাওনি - সে আমের স্বাদ পেয়েছ বলে নিজেকে নিয়ে গর্ব করা নীচু নৈতিকতার পরিচয়। তাকে সুবিধাবাদী বলে। তুমি যে পরিবেশে থাকো, সেখানের অর্থনীতি, আইনকানুন, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি কিসে তোমার বা তোমার পূর্বপুরুষের অবদান বলতে পারো? এখানে যদি কিছু গোলমাল থাকে তবে সে তোমার পূর্বপুরুষদের জন্যেই। তার সমাধানের দায় অবশ্যই তোমার। আজ যে দেশের তুমি গর্ব করছ, এত বড়াই করছ, তারাও তো একদিনে হয়নি। কিন্তু তারা যদি সেই গড়ে ওঠার দিনে তোমার মত গড়ে থাকা দেশে গিয়ে গর্ব করত তবে তাকে তুমি কি বলবে? আমি বলব কাপুরুষ! কাপুরুষের বিচারে নিন্দা, ঈর্ষা, তুলনা এরকম নানা চিন্তা অহরহ জাগে। সে বিষে সে নিজে আর নিজের চারপাশকে তছনছ করে ফেলে সে নিজের অজান্তে। যত তাড়াতাড়ি পারো বাবা নিজের নীতির মানদণ্ডটাকে উন্নত করো, আর যদি হারিয়ে ফেলে থাকো তবে খুঁজে বার করো। কারণ জগতে জোঁকের শ্রমের থেকে কেঁচোর শ্রমের মূল্য অনেক বেশি। আর জগতে নৈতিক শ্রমের মানেই শ্রমের মান, বাকিটা পণ্ডশ্রম কেবল।