Skip to main content

গভীর জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে একটা নীলপদ্ম ফুটে। এই জঙ্গলে নীলপদ্ম বিশেষ একটা ফোটে না। সবাই ভাবল, এ কিরকম ফুল? কেউ দেখল সন্দেহে, কেউ দেখল ঈর্ষায়, কেউ দেখল তাচ্ছিল্যে। পদ্ম চুপ করে থাকে। কাকে বলবে সে? আর কি-ই বা বলবে?
        একদিন পুবাকাশে ভীষণ মেঘ করে এলো। শ্রাবণের প্রথম কালো ঘন মেঘ। সে কি তার রাজবেশ! তার গর্জন! তার শোভা! বনের মধ্যে ছায়া ঘনিয়ে এলো। বড় বড় গাছের তলায় অন্ধকার জমাট বেঁধে এলো ধীরে ধীরে। ময়ূর পেখম মেলল। তার নীল পেখমের আন্দোলনে সে স্বাগত জানাল প্রথম বর্ষাকে। ঘাসে ঘাসে শিহরণ জাগল। ব্যাঙগুলো নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ডেকে সারা জঙ্গল মুখরিত করে তুলল। হঠাৎ দিল দমকা বাতাস। ভেজা বাতাস। সরোবরের বুকে লাগল দোলা।
        কি আশ্চর্য! বৃষ্টির প্রথম বিন্দুটা পড়ল এসে পদ্মের উন্মোচিত বুকের কেন্দ্রে। পদ্মের জীবনে প্রথম বর্ষা এটা। তার নীল পাপড়িতে বিন্দু বিন্দু পড়ল জলের ধারা। সে অধীর হয়ে উঠল। মেঘের দিকে সলজ্জ দৃষ্টিতে তাকালো, তার বুকের ভিতরের এত গভীর গোপন তৃষ্ণার কথা মেঘ জানল কি করে? তার নীল পাপড়ির রঙ এলো আরো কোমল হয়ে। সে কোমল নীলের ভাষা যেন বুঝল মেঘ। একটা দমকা হাওয়ায় ময়ূরের পেখম থেকে গাঢ় নীল রঙের একটা শাখা উড়ে এসে পড়ল তার বুকে। পদ্মের বুকে জাগল শিহরণ, আকাশে মেঘের বুকে খেলে গেল বিদ্যুৎ। পদ্ম চোখ বুজল। সারা শরীর-মন-প্রাণ তার ভিজে গেল প্রথম বর্ষার নবধারা জলে। সে সমর্পণ করল নিজেকে, কৃষ্ণমেঘরূপী তার দয়িতকে।
        বর্ষা গেল। চারদিক থইথই করে ভাসছে জল। সারাটা বন জুড়ে নবযৌবনের সাজ। শরৎ এলো। পদ্মের তখন সারা শরীর-মন জুড়ে প্রবল যৌবনের বন্যা। কিন্তু হঠাৎ এ বিরহের জন্য সে তো প্রস্তুত ছিল না। এ বিরহ তার জীবনের প্রথম বিরহ। সারা আকাশ জুড়ে যখন সাদা শরতের মেঘ ভেসে বেড়ায়, সে অধীর হয়ে ওঠে। ব্যাকুল হয়ে আকাশের এ কোণ সে কোণ চায়। কোত্থাও কিচ্ছু নেই। শুধু নীল আকাশ, আর তার বুকে তার দয়িতের প্রেমসুধারিক্ত সাদা মেঘ।
        সেদিন পূর্ণিমা। শরতের পূর্ণিমা। আকাশে সে কি সাজো সাজো রব। চারদিকে যেন সাদা অমৃত ঢেলে দিচ্ছে স্বর্গপূরী থেকে গন্ধর্বেরা। পদ্মের বুকের থেকে প্রেমের মত্ত সৌরভ বেরোলো অভিসারে। সে খুঁজে নিয়ে আসবে আজ তাকে। আনবেই তাকে। পদ্ম ব্যাকুল হয়ে অধীর অপেক্ষায় আকাশের দিকে চেয়ে। তার বুকের সৌরভ গেছে বিরহবার্তা নিয়ে। সবটুকু বিরহ উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে সে গন্ধে, যেন নিজেকে নিঃশেষ করে সম্পূর্ণ। আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে তার ঘুমে চোখ এলো ঢুলে। সে দেখল, মধ্যগগনে সাদা মেঘের মধ্যে চাঁদ লীলা করছে। সে প্রেমের সুধা বিন্দু বিন্দু পান করছে সারা আকাশ, মেঘ। কিন্তু সে সুধা তো তার নয়! তার তন্দ্রা এলো চোখে। 
       আচমকা ঘুম ভাঙল কিসের স্পর্শে তার বুকে। সে চোখ মেলে দেখে কালো ভ্রমর একটা। কি তার রঙ! ঠিক যেন সে মেঘরাজের মত। ভ্রমর হেসে বলল, "তোমার সৌরভ ডেকে আনল আমায়।" পদ্ম চুপ করে রইল। সে দেখল পূর্ণিমার চাঁদ অস্তমিত প্রায়। সারা আকাশ জুড়ে জুঁইয়ের মত তারারা ফুটে।
        ভ্রমর বলল, "আমি তার দূত, সে আসবে আবার। কয়েক ঋতু পর। তুমি ধৈর্য্য ধরো। সে বলেছে তোমার বুকের রেণুমাখা হয়ে যেন আমি ফিরি, সে তোমার প্রেমের সুধায় জাগিয়ে তুলবে শুষ্ক, রিক্তপ্রাণ ফুলেদের। সে বলে পাঠিয়েছে, সে জাগানোর দায়িত্ব কি শুধু তার একার?"
        পদ্মের সারা শরীর রোমাঞ্চিত হল। সে তার সমস্ত রেণু ভ্রমরের পায়ের রোঁয়ায় মাখাতে মাখাতে বলল, "তুমি প্রতিদিন এসো। আমার বুকের সমস্ত রেণুমাখা হয়ে ফিরে যেও তার কাছে, তাকে বোলো এ তুচ্ছ জীবনের মধ্যে জীবন সঞ্চার করেছে সে, আমার সমস্ততে শুধু তারই অধিকার। সব তার, তার, শুধু তার।"
        ভ্রমর চলে গেল। তখন পুবাকাশ ঈষৎ অরুণ। হঠাৎ পদ্মের মনে হল, তার পাপড়ি যেন ভেজা, তার বুকের ভিতর পশমও যেন ভেজা। কে ভেজালো? সে ছুঁয়ে বুঝল সে ভোরের শিশির। তার প্রাণে বাজল ভৈরবীর সুর। সে যেন বহু যোজন দূর থেকে অলক্ষ্যে এসে ছুঁয়ে গেল তাকে। বলে গেল, "আমি আছি, আমি আছি, আমি আছি।"
        পদ্ম নীলাক্ত হল।