সৌরভ ভট্টাচার্য
17 November 2016
১
---
শেষ মুহুর্তটায় তো মনে হচ্ছিল আর বুঝি যাওয়াটাই হল না। টাকা কই? সব তো পাঁচশো আর হাজারের নোট। তবু শেষরক্ষা হল। যাওয়ার আগের দিন ব্যাঙ্কে দৌড়াদৌড়ি করে টাকা কিছুটা যোগাড় করা গেল। যাত্রী দশজন, অর্থ নিতান্তই অপর্যাপ্ত। তবু পাড়ি দিলাম। দেখাই যাক না, যা হবে হোক – এই হল দর্শন। চারদিকে গেল গেল রব… অমুক হবে… তমুক হবে…। এ অবশ্য নতুন কিছু না। বাঙালীদের মারা যাওয়ার কোনো বিশেষ গুরুগম্ভীর কারণ সবসময় লাগে না। লাইনে দাঁড়াতে মারা যাচ্ছে। শীতে মারা যাচ্ছে। গরমে মারা যাচ্ছে। চেক ভাঙ্গাতে মারা যাচ্ছে। কালো টাকা সাদা হচ্ছে না বলে চিন্তায় মারা যাচ্ছে। টাকা তুলে নেওয়া হল বলে গরীবরা কি খাবে বলে দুশ্চিন্তায় মারা যাচ্ছে (অবশ্য এমনিতে পাশের বাড়ির লোকের সুবিধা অসুবিধার কথা জানার সময় নেই) … এরকম হাজার রকম কারণে মারা যাওয়া বাঙালীদের ছেড়ে বেরিয়েই পড়লাম উৎকল দেশে।
হোটেলের মালিক পাঁচশ, হাজারের নোট নেবে বললেন; খাওয়ার ওখানেও কথা হল, তিনিও নেবেন; গাড়ির লোক বললেন, নেবেন। অগত্যা অর্থের অনর্থ আর ঘটল না।
তবে পুরীতে নেমেই বুঝেছি চারদিক ঠিক যেমনটা চিনি তেমনটা যেন নয় কোথাও একটা। এত লোক কেন? শুনলাম কার্তিক মাসের পূর্ণিমা সামনে। মানে রাস। তার এত ভিড়। সে বলে ভিড়! চারদিকে থিকথিক করছে মাথা আর মাথা। সেদিন রাস। সোমবার। ভেঁপু বাজছে, খোল করতাল বাজছে, বাচ্চা কাঁদছে, নানান ভারতীয় ভাষায় হইহট্টগোল বেধে গেছে চারদিকে। খালি পা আবালবৃদ্ধবনিতা চলেছে জগন্নাথ দর্শনে। মন্দিরে ঢুকতে হলে সারাদিন লাইনে দাঁড়াও। তার চেয়ে থাক লোক দেখি। কেউ ঠকাচ্ছে, কেউ ঠকছে। কেউ হাঁটছে, হাত পাতছে, কেউ বসেছে রাস্তার পাশে চাদর পেতে সত্যি নুলো কিম্বা মিথ্যা নুলো হয়ে। পাণ্ডা যাচ্ছে, ধনী দরিদ্র যাচ্ছে, মানত করা লোক যাচ্ছে, অবিশ্বাসী ভ্রূ কুঁচকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে, বিশ্বাসী গদগদ দৃষ্টিতে প্রভু দর্শনের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে, যুবক যুবতীরা আদিরসে কটাক্ষে ছোঁয়াছুঁয়িতে জাল বিছিয়ে চলেছে।
এ সব আছে। থাকবেই। কারণ মানুষের মধ্যে সব চাইতে বড় সত্যি তার খিদে। পেটের খিদে। কামের খিদে। সৌন্দর্যের খিদে। মানের আর জ্ঞানের খিদে। সব খিদে কারোর মেটে না কোনোদিন। মিটতেও নেই। জ্যান্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার চাইতে অভুক্ত ভিখারী হয়ে বাঁচা ঢের কাজের। তাই তাকিয়ে দেখো, ওই ছেঁড়া গামছা পাতা ভিখারী, ওই সোনার হার পরা পাণ্ডা, ওই লাইনে দাঁড়ানো অজস্র নরনারী- সব দু'হাত পাতা। তবে হ্যাঁ, নিজের খিদে নিয়ে আবার লজ্জাবোধ আছে এদের। তাই এত ওজর খোঁজে খিদেকে জানান দেওয়ার। বাচ্চাদের সে ওজর নেই। তাই তার রাগ আছে, কান্না আছে। এদের আছে কুটিল জটিল ষড়যন্ত্রের প্যাঁচ। তাই এত পাপ-পূণ্যের ফিরিস্তি। সভ্যতার যদি গতি না থাকে তবে তা হত দুর্গন্ধযুক্ত পুরোনো কম্বলের মতন কদাকার। সে শুধু ঢাকবেই যা কিছু আসল, তাকে রূপ দেবে না, মুক্তিও দেবে না। বলবে আমিই আসল, ভিতরেরটা শুধুই মিথ্যার ঢেলা। আর সেই আদিম খিদে যত চীৎকার করবে, এরা তত তার গলা টিপে ধরবে; বলবে ওটা অসুর, ওটা জান্তব, আমার দিকে তাকিয়ে দেখো, আমি কেমন দিব্য, কেমন স্বর্গীয়। তবে চিরটাকাল কম্বলের সে গুমোর থাকে না। খিদের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। কেমন? এসো কোণার্কে বলছি।
২
---
কোণার্ক নিয়ে যে ইতিহাসটা বারবার বলা হয়, আমার মন কোথাও একটা সায় দেয় না তাতে। সবাই নাকি এত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হচ্ছিল যে মানুষ কাম ভুলে যাচ্ছিল। তখন মন্দিরে কিছু পানুমার্কা ছবি দিয়ে দেওয়া হল, আর অমনি লোকজনের কামবিৎ ফিরে এলো। এ যেন অর্ধসত্য, গল্প। থাক না সে ইতিহাস। যৌনতার কোনো ইতিহাস নেই, সে চিরকুমার অথবা কুমারী। তার মধ্যে শুধুই জান্তব প্রয়োজন আছে বললে, ফুলকেও শুধু গাছের জননাঙ্গের বেশি বলার অধিকার থাকে না। সব সৌন্দর্যেরই একটা বস্তুগত ভিত থাকে, না হলে তা কালের হাওয়ায় উড়ে যায়। যেমন ইতর লোকে বোঝে ডিওর গন্ধের মহিমা, সে অরসিক। প্রেমিক বোঝে প্রেমিকের/প্রেমিকার গায়ের গন্ধের মাধুর্য – সে রসিক। বস্তুগত স্থূলদিকটাকে পরিহার করে তার মধ্যে থেকে সৌন্দর্যের রসটুকু নেওয়া রসিকের কাজ। সে কাজ ঘোর বাজারবাদীরও না, আবার বিকারগ্রস্থ কামুক-লম্পটেরও না। সৌন্দর্যের একটা নিজস্ব সংযম আছে, একটা পরিমিতবোধ আছে। রসিকের সেটা না থাকলে একান্তই চলে না। কোণার্ক তার একটা চূড়ান্ত নিদর্শন। তাকে কেন কোনো সাংসারিক প্রয়োজনের ফিরিস্তি দিয়ে নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করতে হবে? সে তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আর সত্যি বলতে কি কোনো দায়বদ্ধতা থেকে কোনো মহৎ বা সার্থক শিল্প জন্মায় কি? জন্মায় না।
আমি কোণার্কের সুন্দর করে ছাঁটা সবুজ ঘাসের মখমলে বসে। আমার পিছনে পূর্ণিমার চতুর্দশীর চাঁদ উঠছে ধীর গতিতে। আমার সামনে কোণার্ক মন্দির মহাকালের কোলে ক্ষণকালের তৃষ্ণাকে জয়যুক্ত করে চিরটাকাল। আমার হাতে ধরা টলস্টয়ের ছোটো গল্পের হিন্দী অনুবাদ। এই মুহুর্তটার কি কোনো দায়বদ্ধতা আছে? নেই। কারোর কাছেই নেই। যে শিল্পীর মানসপটে মন্দিরের গায়ের এ রূপগুলো আঁকা হয়েছিল, যে লেখক মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহুর্তগুলোকে আঁজলায় ভরে আমার সামনে এনে দিয়েছেন, যে চাঁদটা এতবড় আকাশে একলা এসে দাঁড়িয়েছে মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে – এসবের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আপন অস্তিত্বের সত্যে যদি নিজেকে মেলে ধরতে না পারি, তবে দায়বদ্ধতার তকমা লাগিয়ে শিল্পের জগতে আসা মানে সেই পুরোনো কম্বলের গল্প হয়ে দাঁড়ানো।
যে সৃষ্টি প্রকাশিত হয় অব্যক্ত আনন্দের বেদনার উৎস থেকে, তার গতির ব্যাকরণ হয় না, সুরের স্বরলিপি হয় না। তার শুধুই প্রকাশ হয়। আর কিচ্ছু হয় না। এর থেকে যা অতিরিক্ত, তা নিতান্তই বাড়তি। প্রয়োজনের বাড়তিতে সংসারে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না, তাতে ভবিষ্যতের সঞ্চয় হয়; কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে তা তো না, সেখানে স্বল্প বাড়তিতে শিল্পটাই নষ্ট। তাই যে কোনো মহৎ শিল্পের মধ্যে একটা ভৈরবের উদাসীনতা থাকে। কোণার্কও তার ব্যতিক্রম না। সেটা অনুভব করতে করতে মনের মধ্যে যন্ত্রণা হয়, তার কোনো অর্থ নেই, ক্ষোভ নেই, সে যন্ত্রণাটাতে নিজেকে আচমকা দৈনন্দিন সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন লাগে, নিজের সেই ভীষণ একা অস্তিত্বটা একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায়, অজানা অভাব বোধে ভিতরটাকে নিংড়াতে থাকে, কান্না পায়। একটা মহৎ শিল্প মহাকালের সাথে এভাবেই আমার পরিচয় ঘটিয়ে যায়। আমার বেঁচে থাকাটা সেই ক্ষণকালেই চিরকালের জন্য সার্থক হয়। আবার স্বেচ্ছায় ফিরে সংসারের বেড়ি তুলে নেওয়া যায়। সে আর ততটা কঠিন না তখন, তারও একটা সুর আছে, একটা ঝংকার আছে, চিনতে শিখে গেছি যে!
৩
---
"ট্যাংরা মাছের ঝোল খেয়েছেন…" "না না পাবদা…" "আরে রাখুন পাবদা… উনি তো ভ্যাদা মাছ ছাড়া খানই না…"
সামনে নীলাচল, বাঁদিকের আকাশে সুপারমুন, আমার পিছনে বসা বাঙ্গালী পরিবারকুলের আলোচনার অংশবিশেষ।
আমার সামনে হতদরিদ্র ভারতবর্ষের ছেঁড়া ছেঁড়া পাতারা। কেউ মিষ্টি, কেউ নকল মুক্তোর হার, কেউ দরজায় চিপকানো জগন্নাথের দাদা-বোনসহ ছবি, কেউ আরো নানান সামগ্রী, আবার কেউ শুধু দুটো হাত পেতে বলছে খাওয়ার টাকা দাও। একটা বাচ্চা মেয়ে এসে দাঁড়ালো, বয়েস নয়/দশ হবে, সবুজ ছেঁড়া ফ্রক, রুগ্ন দেহ… বলল, খেতে দেবে?...
আমার বাঁ আকাশে সুপারমুন… আমার থেকে কয়েক মাইল দূরে দাঁড়িয়ে অসহায় জগন্নাথ মানুষের ভক্তিবিহ্বল অন্ধ হৃদয়ের কাছে, আমার সামনে একটা ক্ষুধার্ত মানুষ। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছায় ওর আজ খাওয়া জুটবে… হা ঈশ্বর!!! আমায় মানুষ করলে যদি কালা, অন্ধ করলে না কেন?... হা ঈশ্বর আমায় মানুষ করলে যদি হৃদয় দিলে কেন?...
হাতে ধরা বিস্কুটটা দিলাম, দু'জন বন্ধুও দিল… মেয়েটা হাসল। চলে গেল। আমার সুপারমুন ঝাপসা… আমার সামনে ওরা কারা? ওই যে জগন্নাথ মন্দিরের দাওয়ায় শোয়া শূন্যদৃষ্টি উঠতে না পারা বৃদ্ধা, আরেক দরিদ্রা রমণী তার মাথাটা কোলে নিয়ে বন্ধুর কানে কানে কিছু বলছেন, তাকে ওঠাতে চেষ্টা করছেন, ভিড়ের ধাক্কা সামলে তাকে আগলে যে দুটো হাত, সে কার? আমাদের এই সহস্র হাতের ভরসাতেই কি জগন্নাথ নিজের হাতদুটো অপ্রকাশিত রেখেছিলেন? আর আমরা রইলাম সেই অপ্রকাশিত হাতদুটোকে স্তবস্তুতির চাতুরীতে বাইরে টেনে দৈব বলে জাগিয়ে তোলার? তাই জগন্নাথ আর তার জগৎ দুই রয়ে গেল পর আর পরবাস হয়ে আমাদের কাছে? যাকে অন্তরে না পাই, তাকে বাইরে অনেক আড়ম্বরে সাজাতে হয়। তাই আমার তৈরি জগন্নাথ শুধুই হিন্দুনাথ... অহিন্দুর প্রবেশ নিষেধ... তার মন্দিরকে ঠেকনা দিতে লোহালক্কড়ের ডাক এসেছে স্থপতিকারের থেকে... আর যিনি সত্য অর্থে জগন্নাথ, সেই অনাদি চেতনা বারবার করাঘাত করে চলেছে। অমঙ্গল অন্ধকারে না, অমঙ্গল নকল আলোয়। সেটা বোঝার মত ক্ষমতা থাকলেও, মানার মত মেরুদণ্ডটা তৈরি হয়নি যে! তাই চলুক নিয়ম... বাঁচুক কৃষ্টি... চেতনা মরুক গম্ভীরায় একা ডেকে ডেকে মানুষের প্রাণের ঠাকুরকে... মাথায় শ্যাম্পু করার সময় চোখে শ্যাম্পু লাগার ভয়ে চোখটা না খুলে টবের জলে মগ হাতড়িয়ে খুঁজি। সে অন্ধত্বে না, পরিস্থিতিতে। সেই খোঁজাকেই যদি রীতি বানিয়ে, সারাটা জীবন চোখ বন্ধ করে মগ হাতড়াই, তবে মগও মিলেও মেলে না, আর চোখ জন্মের মত অন্ধকারেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। কেউ হাত বাড়িয়ে মগটা এগিয়ে দিতে এলে বলি, ‘ব্যাটা আজন্ম নাস্তিক!!’ আমাদের হয়েছে সেই দশা। কেউ দিলেও নাইব না, নিজেও মগ খোঁজার বাহানা করে মগ এড়িয়ে চলব। আর দোষরোপের জন্য তো ভাগ্যবিধাতার তেত্রিশ কোটি রূপ বানানোই আছে। উপরে ভগবান আর নীচে রাজা (আধুনিক কালে সরকার) - এরা আছেন কি করতে, দেব ওদের দোহাই...
বাড়ির রাস্তায় পৌঁছালাম... হ্যাঁ গো পাঁচশ-হাজারে সমস্যা হয়নি?... কি কি খেলে?... গরম না শীত? যা হোক কষ্ট হয়নি?... কাল ব্যাঙ্কে লাইন দেবে তো?... জানো ATM টাকা ঢোকায়নি এখনো... কি যে খাব?... মোদী যে কাণ্ড ঘটালেন... আরে আমাদের দিদি তো... ওদিকে বামফ্রন্ট কি বলছে শুনেছ...
না শুনব না... প্রতিক্রিয়াটা প্রতিক্রিয়া হলে ঠিক আছে... প্যাঁচাল হলে বড় বিরক্তিকর... যখন কাজটা করতেই হবে, তখন হবে... বুঝলাম বাড়ি এসে পড়েছি...
মনের মধ্যে শুধু একটাই দৃশ্য এখন। চন্দ্রভাগা সমুদ্রের তীর। মঞ্চে চলছে ওড়িশি নৃত্য। আকাশে পূর্ণচাঁদ। মঞ্চের পিছনে গর্জনরত সমুদ্রের সাদা ফেনার রাশি। গান হচ্ছে - মাতৃবন্দনা। নৃত্যশিল্পীরা দূর্গাবন্দনা অভিনয় করছেন। মা’কে বন্দনা করছেন। মৃদঙ্গের বোল আর ঢেউয়ের রোল মিলেছে ধ্রুপদী ছন্দে, সাথে নূপুরের আওয়াজ নানান ভঙ্গিমায়, মুদ্রায়...
কোথা থেকে জানল মানুষ, শরীরের এমন একটা নির্বাক অভিব্যক্তি আছে? বিশ্বের ছন্দের সাথে মিলিয়ে তাকে গেঁথে রেখেছে নানান মুদ্রায়। মনে হল, অনেক পুণ্যের ফলেই নিশ্চই এদেশে জন্মানোর সৌভাগ্য মেলে। শুধু চোখ-কান-মন’টা মেলার অপেক্ষায় থাকা।
(ছবিগুলোর জন্যে কৃতজ্ঞ রইলাম দেবাশিষ, প্রীতম, জয় আর আদিত্যর কাছে। আর লেখাটার জন্য অবশ্যই বারবার তাগাদা ছিল Sanhita র কাছ থেকে, ওর একটা বিশেষ ভূমিকা নেপথ্যে রইলই তাই। অনেক ধন্যবাদ সক্কলকে)