|| নীলপাখী ||
সকাল সাড়ে ৭টা। সমীর এই সময়টা এখন ছাদে এসে বসে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। ঠাণ্ডাটা মোটামুটি। খুব একটা লাগছে না। হালিসহরের এদিকটায় তত ঘনবসতি এখনো হয়নি। চারদিকটা বেশ সবুজ। কুয়াশামাখা রোদের আলো, ঠাণ্ডা হাওয়া, বিভিন্ন পাখির ডাক - সব মিলিয়ে সমীরের এই সময়টা সবেচেয়ে ভালো লাগে। সমীর আলতো করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারছে। চোখটা বুজে আসছিল। সিঁড়ি বেয়ে সুতপার ওঠার আওয়াজ পেল। চা নিয়ে আসছে। সমীর চোখটা খুলল। সুতপার মুখের দিকে তাকাল। সকালের আলোয় সুতপার মুখটা দেখল এখনো তার বুকের ভিতরটা ছলাৎ করে। কলেজের দিনগুলোর মত।
সুতপা জানে সমীর এইসময় কথা বলে না। সুতপা চায়ের কাপটা রেখে পাশ থেকে সমীরকে একবার খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়াল। ওর চাদরের মধ্যে বুকের কাছে সমীরের মুখটাকে কিছুক্ষণ চেপে ধরে থাকল। একটা ভীষণ কান্না সুতপার গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে এই সময়। ডাক্তার বলেছেন, বড়জোর আর একবছর। নিজেকে সামলে মুখটা সমীরের কাছে এনে একটু হেসে ফিসফিস করে বলল, "যাই। তিতিরকে স্কুলের জন্য রেডী করতে হবে।" তিতির তাদের ন'বছরের মেয়ে। সুতপা জানে তার দুই চোখের কোণে ছোট দু'বিন্দু জল সমীরের চোখ এড়ায়নি।
সুতপা নেমে গেল। সমীর চাদরটাকে আরেকটু জড়িয়ে টানটান হয়ে বসল। গভীর একটা শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়ল। প্রতিটা শ্বাসকে সে এখন অনুভব করতে পারে। ওই তো! নীলপাখীটা এসেছে। মোবাইলের টাওয়ারের ওপর বসে! প্রতিদিন সকালে এই পাখীটাকে দেখতে দেখতে সমীরের কেমন একটা আত্মীয়তা হয়ে গেছে এই পাখীটার সঙ্গে। গত সপ্তাহে কেমো নিয়ে আসার পর ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছাদে উঠতে পারত না। লেপের মধ্যে শুয়ে শুয়ে সে কল্পনা করত, না, যেন দেখতে পেত নীলপাখীটা টাওয়ারের উপর এসে বসেছে। একদিন তিতিরকে ছাদেও পাঠিয়েছিল।
"যা তো মা, ছাদে গিয়ে দ্যাখ তো সামনের মোবাইলের টাওয়ারের একটা ছাদে নীলপাখী বসে
আছে কি না!"
শুনেই তিতির "আচ্ছা" বলে ছুটতে যাচ্ছিল।
সমীর বলল, "দাঁড়া, কী বলবি শুনে যা। তাকে গিয়ে বলবি, বাবা এখন অনেকটা ভাল আছে। আর ক'দিন পরেই তোমার সঙ্গে বাবার দেখা হবে।"
এর পরের ঘটনাটা খুব মজার। তিতির হাঁপাতে হাঁপাতে নীচে এসে বলে, "না বাবা! কােনো নীলপাখী মোবাইলের টাওয়ারে নেই তো! নারকেল গাছে একটা কাক বসেছিল, আমি ওকে বলে দিয়ে এসেছি। ও ওই নীলপাখীটাকে বলে দেবে। ভালো হল না বাবা?"
সমীর 'হা হা' করে হেসে উঠেছিল। তিতির তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কিছু বুঝতে না পেরে সমীরের ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে "হাসছ কেন? হাসছ কেন?" বলে মারতে শুরু করল। তারপর সুতপা এসে বাকিটা সামাল দেয়।
|| অসহায়তা ||
সমীরের এখন আর ভয় করে না। একেবারে করে না, তা না, মাঝে মাঝে করে ----- তবে অনেক কম। গতবছর যেদিন ওর বায়পসি রিপোর্টটা আসে সেদিনের কথা মনে পড়লে নিজেকে এখন অন্য মানুষ মনে হয়। ও আর সুতপা তিনদিন প্রায় নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারেনি। ভয়ে আতঙ্কে বিভীষিকায় সে পুরো আধমরাই হয়ে গিয়েছিল! তারপর শুরু হল আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর বাঞ্ছিত অবাঞ্ছিত সত্য কাল্পনিক হাজারো উপদেশ পরামর্শ --- উফ্ ফ্ ফ্... হাঁপিয়ে উঠেছিল ওরা দু'জন। তারপর ধীরে ধীরে এগুলো কেমন গা সওয়া হয়ে যেতে লাগল। কথাগুলো কিছু শব্দমাত্র ঠেকত। কোনো মানে তৈরী হত না। সুতপা তো অনেক সময় বলে দিত, সে বাড়ী নেই।
তারপর শুরু হল হৃদয়হীন চিকিৎসকদের (অবশ্যই সবাই নয়) উদাসীন চিকিৎসাশাস্ত্রের অত্যাচার। কতটা সহানুভুতিহীন স্বার্থান্ধতা মানুষের হৃদয়কে গ্রাস করে থাকে --- অবাক লাগত। উচ্চশিক্ষা আর অমানবিকতার এই সহাবস্থানটাও সমীরের গা সওয়া হয়ে গেল। বহু মানুষ অযাচিতভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েওছিল। বিশেষ করে তার অফিসের ইমিডিয়েট বস --- সুকান্তদা। তিনি না থাকলে ডক্টর মৈত্রকে হয়ত বা কোনদিন আবিস্কার করতে পারত না। আবিস্কারই বটে। চিকিৎসার মরুতে যেন ওয়েসিসের মত। সুতপাকে অত কাঁদতে সে কোনদিনও দেখে নি। ডক্টর মৈত্রের চেম্বারে যেভাবে সে দেখেছিল। খুব লজ্জাও লেগেছিল সমীরের। কী অসহায় একটা মানুষ হতে পারে! গাড়ীতে যখন ফিরছিল সুতপার চোখে মুখে সে এক উৎসাহ উজ্জ্বলতা লক্ষ্য করেছিল। কিন্তু তার হৃদয় কিছুতেই সাড়া দিতে পারছিল না। গাড়ীর বাইরের ব্যস্ত বিকেলের কলকাতাকে কেমন অর্থহীন মনে হয়েছিল। বাসে ঝুলন্ত লোক, পথে হাটা খেটে খাওয়া মানুষ, বড় বড় ফ্ল্যাটে দাম্ভিক শিক্ষিতের দল --- কী বোকা আমরা! সবশেষে সেই অসহায়তা! কী অসহায় আমরা!
|| কেন রে এই দুয়ারটুকু ||
ঘুম আসছিল না সমীরের --- আজও। তিতিরকে বুকে জড়িয়ে সুতপা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ওর মুখে একটা শান্তির ছায়া --- অনেকদিন পর। খুব ক্লান্ত ও। সমীর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে ওর মাথায় হাত রাখল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বাথরুমে আসল। আলোটা জ্বালল। চারিদিকে শীতের রাত্রির গভীর নিস্তব্ধতা। বাথরুমের চারিদিকে চোখ বোলাল। শাওয়ার, কমোড, ছোট্ট র্যাক, দরজা --- আলোটার পাশের টিকটিকিটা --- কত চেনা। তবুও আজ কেমন যেন অচেনা লাগছে। সব ছেড়ে যেতে হবে! কোথায়? টিকটিকিটার খুব কাছে এসে দাঁড়াল। আজ তার কোনো ভয় করছে না। নয়তো টিকটিকিতে সমীরের খুব আতঙ্ক। মনে হল তাকে একটু হাতে নিয়ে তার গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দেয়। প্রাণের কী কম মূল্য? হোক না টিকটিকি! হঠাৎ ভীষণ কান্না পেতে লাগল। বাথরুমের মেঝেতে উবু হয়ে বসে কলটাকে শক্ত করে ধরে খুব কাঁদতে লাগল। ডুকরে ডুকরে। সে বুঝল সে কাঁপছে --- তার খুব ঠাণ্ডা লাগছে। ভয় যেন সহস্র ফণা নিয়ে তাকে গ্রাস করে ফেলছে। তার মনে হল এখনি ছুটে গিয়ে সুতপা আর তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলে, সে যেতে চায় না। সে তাদের ভীষণ ভালবাসে --- সব দিয়ে। একই সাথে মনে হল --- না, ভয় পেয়ে যাবে। মনকে বলল, “কাঁদো। যত ইচ্ছা কাঁদো। কিন্তু কারোর সামনে না।” অনেকক্ষণ এভাবেই কাটল।
কতক্ষণ হয়ে গেছে তার মনে নেই। মনে হল সে যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল কিছুক্ষণ। নাকি অন্য জগতে চলে গিয়েছিল! খেয়াল করল ভিতরে ভিতরে কেমন একটা শক্তি অনুভব করছে সে! ধীরে ধীরে উঠল। বাথরুমের দরজা খুলল। কম্বলটাকে বিছানার থেকে তুলে গায়ে জড়িয়ে ধীরে ধীরে ছাদে উঠল। ক্ষীণ আভা পূব আকাশে। চুপ করে বসল --- পূবদিকে তাকিয়ে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথও এরকম বসতেন না? সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল। পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখে কী এক অকারণ আনন্দে জল এসে পড়ল। সে আটকালোও না, লজ্জাও পেল না। হাতদুটো কোলের কাছে রেখে রবীন্দ্রনাথের মুখটা সে বুক ভরে অনুভব করল। কে যেন তার হৃদয়ে এসে দাড়াল। যেন কতযুগ পর। সে বলল, “অত ভয় পাও কেন? শোনোনি? তুমি অমৃতের পুত্র? শোনোনি-
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ ---”
এক গভীর প্রশান্তিতে সমীরের শরীর মন পাখীর পালকের মত নরম হয়ে আসল। মনের গভীর থেকে উঠে আসল, “কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়?” সমীর ঘুমিয়ে পড়ল। যখন চোখ মেলল তখন সূর্য উঠেছে। মোবাইলের টাওয়ারে একটা ছোট্ট সুন্দর নীলপাখী। খেয়াল করল তার পিছনে সুতপা এসে দাড়িয়েছে। তার কাঁধে সুতপার হাত। সে হাতটাকে শক্ত করে ধরল। সুতপার মুখের দিকে তাকাল। বলল,
“আমি পারব।”
|| খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি ||
অগাষ্ট মাস। আজ সকাল থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। সমীর খাটের কোণায় বালিশে হেলান দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে বসে। সুতপা অফিসে গেছে, তিতির স্কুলে। একজন পঞ্চাশোর্ধ বিধবা মহিলা সকালটা সমীরের দেখাশোনা করে। বিমলাদি সমীরের রোগটা নিয়ে সবটা জানে। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে না। তার স্বামীও নাকি এই রোগেই --- । প্রথম যেদিন এসেছিল সমীরের দিকে কেমন 'হাঁ' করে চেয়েছিল কিছুক্ষণ। সমীরের কেমন একটা অস্বস্তি হয়েছিল। বেশ কয়েকদিন পরে সে জানায় --- তাও সুতপাকে।
“তোমাকে কি এখন স্নানের জল দেব?”
বিমলাদির হাবেভাবে একটা অতিরিক্ত স্নেহ সমীর অনুভব করে। বাইরে অনেক কিছু হারালে ভিতরে অনেক কিছু জমে। এটা সমীর এখন কীরকম টের পায়। সমীরের ভিতরেও অনেক কিছু জমেছে। সে বেশ টের পায় তার ভিতরে আরেকটা আমি আছে। তার ভয় নেই। তার আসক্তি নেই। কেমন উদাসীন, আবার কী প্রশান্ত! আচ্ছা, এই কী উপনিষদের সেই আরেকটা পাখী যে স্থির হয়ে উঁচু একটা ডালে বসে আছে? যে সবকিছুর নির্লিপ্ত দ্রষ্টা? সমীর নিজের এত ভিতরে কোনদিন ঢোকে নি। নাকি জানতই না, তার ভিতরেও এত বড় একটা ভিতর আছে! যেখানে রোগ, ভয়, হিংসা, উদ্বেগ কিছুই পৌঁছয় না। এই গভীর অনুধ্যানে সমীর কেমন আবিষ্ট হয়ে পড়ে। আচ্ছা সব মানুষেরই ভিতরে কী এমন একটা ভিতর আছে?
বেশ কিছুক্ষণ পর সমীরের ঘোর ভাঙে। কখন চোখ বুজে ফেলেছিল সে খেয়ালই করেনি। চোখ বুজেও এত স্পষ্ট দেখা যায়! তাকিয়ে দেখে বিমলাদি দাঁড়িয়ে।
“আমি ভাবছিলাম তুমি ঘুমিয়ে গেছ।”
“তুমি গিজারটা অন্ কর। আমি আসছি।” সমীর বলল।
বিমলাদি চলে গেল। তার ঘর থেকে চলে যাওয়া সমীরের কাছে অন্যরকম লাগল। তবে কী আমাদের যাওয়াগুলোও এরকম? এঘর থেকে ওঘর? সমীর নিজের বুকে দু’হাত চাপল। মনে মনে আবৃত্তি করল,
“আনন্দম্, পরমানন্দম্, পরমসুখম্, পরমাতৃপ্তি। হে অমৃতময় পুরুষ। আমার আরোও কাছে এস।”
|| কান্না ||
“কী ভাবছ?”
সুতপা সমীরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অন্যমনস্কভাবেই জিজ্ঞাসা করে। ওরা ডাক্তার দেখিয়ে গাড়ী করে ফিরছে। আজকাল ট্রেনে উঠতে পারে না সমীর। সাফোকেশান লাগে। সন্ধ্যে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। সকাল থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে দুপুরের দিকে ধরেছে। সুতপা খুব টেনশন করছিল, ডঃ মৈত্রের এপয়েন্টমেন্টটা না ক্যানসেল হয়। চিকিৎসায় ভালো সাড়া দিচ্ছে সমীর, ডঃ মৈত্র বলল। সমীর জানলার বাইরে তাকিয়েছিল। প্রায় আধঘন্টা কেউ কারো সাথে কথা বলে নি। এখন সমস্ত ভালো খবরই যেন একটা প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে আসে। এই তো সেদিন তিতির তার কোলের কাছে এসে কিছুটা ভয়ার্ত কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “লিভার ক্যান্সার হলে কী হয়, বাবা?”
সমীর ইন্টারনেটে একটা জার্নাল পড়ছিল। চমকে উঠে ভাবল, তিতির কি ল্যাপটপ খোলে আজকাল?
সে জিজ্ঞাসা করল, “কেন?” শব্দটাকে যেন ঠেলে গলা দিয়ে বার করল সমীর।
তিতির তার কোলে আরো ঘেষে মুখ গুঁজে বলল, “মা কাঁদছিল আর ফোনে বলছিল। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ লিভার ক্যান্সার’ মা তিনবার ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ বলল।” কৌতুকে মুখ তুলে সমীরের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয় বাবা?”
সমীর ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বলল, “পেটের মধ্যে একটা ফোঁড়া হয়।”
“কার হয়েছে?”
সমীর বলল, “আমার।”
“কই দেখি...” বলে সে পাঞ্জাবীটা তুলল, “নেই তো!”
সমীর বলল, “দূর বোকা। ওটা তো পেটের মধ্যে!”
বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞাসা করল, “কী হবে তাহলে?”
সমীর তাকে একথা ওকথা বলে ভুলিয়ে সে যাত্রায় নিস্তার পেল। কিন্তু কতদিন?
“বললে না তো?”, এবার কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে সুতপা জিজ্ঞাসা করল। সমীরের হাতটা নিয়ে নিজের কোলের ওপর রাখতে সমীর ঘুরে সুতপার মুখের দিকে তাকাল। খুব শান্ত গলায় মৃদু হেসে বলল, “কী?”
সুতপা কিছুটা জোর করে ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞাসা করল, “কার কথা ভাবা হচ্ছে, হুঁ...?”
আজকাল স্বাভাবিক ঠাট্টা করতে কী অস্বাভাবিক জোর লাগে! সমীর সুতপার কোলে রাখা তার নিজের হাতটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ছোটেবলা থেকে একটা কথা ভাবলে আমার খুব অবাক লাগে।”
গাড়ীটা ততক্ষণে বারাকপুর ছাড়িয়ে গেছে। সন্ধ্যে নেমে গেছে। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া লাগছে। সুতপা গাড়ীর কাঁচদুটো তুলে দিয়েছে। তাই সমীরের কথার শেষের দীর্ঘশ্বাসটাও সুতপার কানে গিয়ে ঠেকল। সুতপা অস্ফুট স্বরে আবার জিজ্ঞাসা করল, “কী?”
সমীর খুব শান্ত গলায় ধীরে ধীরে বলল, “আমার ছোটবেলা থেকে মনে হয় --- বোধহয় ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর থেকেই, আমিও একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। কিন্তু দেখো, সবকিছুই আগের মত হতে থাকবে। এমনি বর্ষাকাল জুড়ে বৃষ্টি হবে, শরৎকালে দুর্গাপূজা হবে”, একটু হেসে বলল, “লোকসভায় বাজেট পেশ হবে। আমার না থাকাটাতে তো কিছুই আটকাবে না! কিছুই না! খুব অবাক লাগে না?”
সমীর তাকিয়ে দেখল সুতপা জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে চলে যাওয়া লরির টুকরো টুকরো আলোয় মনে হল ওর গালটা ভিজে। সমীর সুতপার মাথাটা টেনে তার কাঁধের ওপর রেখে তার হাতটা সুতপার কাঁধের ওপর দিয়ে জড়িয়ে ধরল। বলল, “তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি। আমি সত্যিই এটা ভাবতাম। অনেক আগে থেকে।”
সুতপা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল। জড়ানো স্বরে বলল, “জানি।”
সমীর মনে মনে বলল, “না সুতপা। তুমি জানো না। আমাদের হাসিগুলো, ছোটো ছোটো আনন্দগুলো এক আদি অনন্ত কান্নাসমুদ্রে ছোট ছোট ঢেউ বই আর কিছু না। তাই কান্নাটুকুই চিরকালের। তবে সেটা চোখের জলের কান্না নয়। সে কান্না দেখা যায় না। প্রতিটা মানুষের হৃদয়ে ডুব দিলেই সেটা ছোঁয়া যায়। তাই তুমি যত কোন মানুষের কান্নার কাছে পৌঁছাতে পারো, তত তাকে ছুঁতে পারো। আবিস্কার করতে পারো।”
|| ওরে মাঝি ||
সমীর বেশ বুঝতে পারে তার শরীরটা ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে, ক্লান্তি বাড়ছে। মাঝে মাঝে শুতে যাওয়ার সময় একটা উদ্বিগ্নতা কাজ করে। যদি আর ঘুম না ভাঙে। প্রথম প্রথম এটা খুব হত। সমীর ঘুমন্ত সুতপা আর তিতিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত। এখন কিছুটা কমেছে। শরীরের শক্তি কমার সাথে সাথে তার উপলব্ধি করার শক্তি যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এতদিন সংসারে শুধু থাকাটাকেই দেখেছে। আজ ছেড়ে যাওয়াটাকে কোথাও একটু একটু বুঝতে শিখছে। সমীর তাঁর উপলব্ধির গভীরে কোথাও একটা সামঞ্জস্যতা যেন অনুভব করতে পারে। তাই তার উদ্বিগ্নতা অনেকটা কম। মাঝে মাঝে কেমন যেন একটা উত্তেজনা কাজ করে। মৃত্যুটাকে ছোঁয়ার, স্পর্শ করার --- কেমন রোমাঞ্চকর আডভেঞ্চারাস লাগে। সত্যি! কিছুটা পাগলামী না থাকলে সংসারটা বড্ড ফিকে হয়ে যায়। সমীরের অনেকটা সময় এখন কাটে গীতবিতানের পাতা উলটে।
সমীর এখন চিন্তা করে না। দেখে। পাখার ব্লেডে ধুলো জমা। দরজার ফাঁকে পড়ে থাকা এক টুকরো কাপড়। মেঝেতে পড়ে থাকা ফাঁকা রিফিল --- সবই তার কেমন আশ্চর্য লাগে। তার মনে হয় সারাদিনের সমস্ত ঘটনা --- প্রতিটা প্রতিটার সঙ্গে কোথাও সংযুক্ত। সমস্ত অস্তিত্ব সমস্ত কিছুর সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে। কিছুই পৃথক না। ভাবতে ভাবতে সে তার নিজের সীমা অতিক্রম করে কী বিশাল এক অস্তিত্ত্বের মধ্যে এসে পড়ে। সেখানে সবাই আছে, সবই আছে --- আবার কেউ নেই, কিছুই নেই। তার মনটা শান্ত হয়ে যায়। বিশ্রাম পায়। আনন্দ পায়। খেলতে খেলতে বাচ্চাগুলো যেমন ক্লান্ত হয়ে মাঠের পাশে এসে বসে পড়ে আর মাঠের দিকে তাকিয়ে খেলা দেখে --- বিধাতা যেন তাকে সংসারের একপ্রান্তে এসে বসিয়ে দিয়েছে। পুরো সংসারটা তার সমস্তটা নিয়ে তার সামনে উপস্থিত। যখন সে ভিতরে ছিল তখন এভাবে কোনদিনও অনুভব করে নি। যখন সে খেলার মাঠে তখন সে এভাবে বোঝে নি। আজ বাইরে এসে সে অনেক স্বচ্ছ। তার জীবন এই বিরাটের মধ্যে ঠিকই স্থান পেয়েছে। তার অন্তর্যামী সবিকছুর মধ্যে তার বোধটাকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন লাগে না। এ এক পরম শান্তি!
|| তবু যা ভাঙাচোরা ||
সমীর অনেকদিন ছাদে ওঠে না। তাই নীলপাখিটার খবর তিতিরই তাকে দেয়। সমীর তার চারপাশের মানুষগুলোকে এখন চেনা বৃত্তে আর অচেনা বৃত্তে মিলিয়ে দেখে। যে ছেলেটা কাগজ দিতে আসে, তাকে এতদিন খেয়াল করে নি। এখন সে জানে ওর বাইরে পরে বেরোনোর দুটোই জামা আছে। একটা লাল ডোরাকাটা আর একটা সাদা টি-শার্ট। এখন সমীর জানে তাদের বাড়ীতে যে দুধ দিতে আসে সেই নুপুরের বাঁদিকের বুড়ো আঙুলে একটা বড় কাটা দাগ আছে। দুধ দুইতে গিয়ে গরুর লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ে কোনো একটা লোহায় ওর হাত নাকি কেটে গিয়েছিল --- সুতপার কাছ থেকে শুনেছে। পাড়া-প্রতিবেশীদের কৌতুহল এখন অনেক কম --- সমবেদনাটা কোথাও একটু স্বাভাবিক হয়েছে, কিম্বা ওরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তিতিরকে আর কিছু অসম্ভব প্রশ্ন করে না। বরং বেশ কিছু বাড়ীতে একটু বেশী প্রশ্রয়ই পায়। এখন চট্ করে সমীরের কারোর ওপর রাগ হয় না। কেন যে মানুষ তার সীমাবদ্ধতাটাকে অসহায়তার সাথে গুলিয়ে ফেলে। সে বুঝতে পারে, কিছুটা দেখতেও পায় --- মানুষগুলো তার সীমার বাইরে কিছু দেখলেই কখনো অপমানিত বোধ করে রেগে যায়, কখনো মিথ্যা অবজ্ঞার ভানে মিথ্যেই নিজের গা বাঁচায়। সমীরের হাসিই পায়। যে সীমার পারে যাওয়ার ডাক তার কানে এসেছে, তাতে আর সব সীমা ধুয়ে মুছে গেছে। প্রতিটা মানুষকেই তার একটা না পড়া উপন্যাসের মত লাগে। সবারই যেন কত কী বলার আছে। কিন্তু মুশকিল হল, এক তো শুনবে কে? আর সে তো নিজেই অনেকটা ভুলে গেছে। আমাদের জীবনগুলো কেমন চেনা-অচেনা, জানা-অজানায় মিশে এক কিম্ভুতরকম একাকার হয়ে গেছে। এই অস্পষ্টতা থেকে বাঁচার জন্য আমাদের কত মিথ্যা জানা প্রতিদিন জমিয়ে তুলতে হচ্ছে। তাই বোধহয় আমরা এত ভীতু। কারণ ভিতরে ভিতরে আমি তো জানি ওগুলো মিথ্যে। সমীর কারোর কথা যখন শোনে তখন শোনা কথাগুলোর আড়ালে তার না বলতে পারা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে। ফলে কোন সত্যিটাকে ঢাকতে সে মিথ্যের আশ্রয় নিচ্ছে বেশ বুঝতে পারে। অলক্ষ্যে একটা স্নেহের প্রশ্রয়ের স্পর্শ তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে। পাড়ার লোকে বলে, সমীরদা অনেক বদলে গেছে।
|| আবার জলে ভাসাই ভেলা ||
রাত্রি সাড়ে বারোটা বাজে। সমীর লাস্ট ঘড়ি দেখেছে যখন বারোটা। সুতপার মা দু’দিন হল এসেছেন। তিতির দিদার সঙ্গে ওঘরে শুয়ে। সমীর জানলার গরাদ বেয়ে পড়া অবাধ্য আলোয় সুতপাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখছিল। কিছু একটা আছে ওর মুখে, ওর শরীরে। এক একসময় মনে হয় এই যেন প্রথম দেখছে।
সুতপার মুখের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে সমীর আলতো করে একটা চুমু খায়। সুতপা চোখ খুলল। একটু হেসে সমীরকে বুকে জড়িয়ে তার মুখটা সমীরের বুকে গুঁজে দিল। সমীরের বাঁহাত সমীরেরও বোঝার আগে সুতপার ব্লাউজের হুকে এসে পৌছাল। সুতপা কিছুটা চমকেই বুক থেকে মুখ সরিয়ে সমীরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “শরীর খারাপ লাগবে...”
সমীর তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “লাগুক।”
এরপরের স্তরগুলো তারা দু’জনেই জানে। তাদের দু’জনের শরীর আর মন খুব ছন্দে বাঁধা। কোনদিনও সুর কেটেছে বলে সমীরের মনে পড়েনি। আজও সুতপার অনাবৃত শরীর সমীরকে একইরকম মুগ্ধ করল। তার মনে হচ্ছিল না সে অসুস্থ। তার হৃৎস্পন্দনের দ্বিগুণ হওয়া, তার ঘামে ভেজা শরীর খুব চেনা --- এমনকি আজও। সুতপার নাভীর চারদিকে চুমু খাওয়া সমীরের বরাবরের প্যাশান। আজও সে পথে এসে যখন সে সুতপার দুই স্তনের মাঝখানে মুখ নিয়ে আসে --- কেমন একটু সন্দেহ হয়। সুতপা তো তেমনভাবে আঁকড়ে ধরল না! অন্যদিন হলে তো তার পিঠ ছিলে যেত। সমীর সুতপার মুখের কাছে মুখটা নিয়ে যায়। সুতপা ফুঁপিয়ে কেঁদে সমীরের গলায় মুখ গুঁজে দেয়। ক্রমশ তার কান্নার বেগ বাড়তে থাকে। সমীরের পিঠে আঁচড় বসে --- আজ তার যন্ত্রনা লাগে। দু’জনের পিঠ বেয়ে দু’জনের চোখের জল নিঃশব্দে পড়তে থাকে। কোনো ভাষা আসে না। কোনো সান্ত্বনা আসে না।
কতক্ষণ তারা এভাবে থাকে তা সমীর জানে না। চমকে ওঠে পাড়ার নৈশপ্রহরীর বাঁশির আওয়াজে। সমীর সুতপার মুখটা তার কাঁধ থেকে সরিয়ে সুতপার ঠোঁটে নিজের ঠোঁটটা গভীরভাবে চেপে ধরে। সুতপা শুয়ে পড়ে। সে কিছুটা শান্ত। সমীর সুতপার ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে তাকে জড়িয়ে তার কানের কাছে বলে, “আমি অপেক্ষা করব। তোমার কাজ শেষ হলে তিতিরকে বড় করে আমার কাছে চলে এস।”
সুতপা সমীরের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আসব। আসব। আসব...”
|| চিরসখা হে ||
সুতপা তৈরী ছিল। হসপিটাল থেকে ফোনটা এসেছিল মাঝরাতে। সুতপা কাঁদে নি। ঘুমন্ত তিতিরের মাথাটা কোলের উপরে রেখে চুলের মধ্যে হাতটা বোলাচ্ছিল। বাড়ীতে অনেক আত্মীয়স্বজন। অনেকেই জেগে। সুতপার সমীরের শেষ কথাগুলো শুধু মনে পড়ছিল, “তুমি আমায় ভরিয়ে দিয়েছ। কোন অভিযোগ, কোনো ক্ষোভ আমার কখনও আসেনি। তোমায় কিছু দিয়ে যেতে পারলাম না। ঈশ্বর সময় বড্ড কম দিয়েছিলেন। আমি পরজন্মে বিশ্বাস করি। জানি তুমি আবার আসবে, আমাদের আবার দেখা হবে সুতপা। বিশ্বাস রেখো। সুতপা, একটা কথা তোমায় বলে যাই, যাই ঘটুক না কেন ভালবাসার উপর বিশ্বাস হারিও না। এর থেকে বড় সত্যি আর কিছু নেই সুতপা। এটা মৃত্যুর থেকেও বড়। বলো, হারাবে না?” ICU-র বেডে সমস্ত শক্তি দিয়ে সুতপার হাতদুটো চেপে সমীর আকুলভাবে আবার জিজ্ঞাসা করেছিল, “কথা দাও। তিতিরকে এই মন্ত্রে গড়ে তুলবে?”
সুতপা তার সমস্ত শক্তি নিয়ে, বিশ্বাস নিয়ে, ঝাপসা চোখে কাঁপা গলায় কথা দিয়েছিল। গলা কাঁপলেও হৃদয়টা কাঁপে নি।
সবার বারণ করা স্বত্ত্বেও সুতপা গিয়েছিল হাসপাতালে। সমীরকে সাজাতে। সমীরকে যখন বাইরে এনে রাখল তখন ভোরের আলো ফুটেছে। ভোরের আলোয় সমীরের মুখটা সদ্য ফোঁটা ফুলের মত লাগছিল। ঠোঁটের কোণে একটু রক্ত লেগে। শেষ কয়েকদিন খুব রক্তবমি হয়েছিল। হাসপাতালে অনেক অচেনা চোখে সুতপা জল দেখেছিল। মনে মনে বলল, “তুমি ব্যর্থ হওনি সমীর!” কোথায় যেন পড়েছিল, ‘মানুষের হৃদয়ে পৌছানো পৃথিবীর দুর্গম স্থানের চেয়েও কঠিন, আবার ফুল ফোটার ছন্দের মতই সহজ।’ ডাক্তার বলেছিলেন, এত শান্ত মৃত্যু তিনি জীবনে খুব কমই দেখেছেন।
সুতপা সাজিয়েছিল সমীরকে, ধৈর্য ধরে, না কেঁদে। অনেক বড় ব্রত যে সমীর তাকে দিয়ে গেল। কাঁদবার সময় তো তার নেই!
সব কাজ মিটতে বিকেল গড়ালো। সুতপা তিতিরকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। ছাদে এসে দেখে সমীরের চেয়ারটাতে তিতির বসে, মুখটা ফোলা, চোখদুটো লাল। সুতপার হৃদয়টা তখনই বোধহয় ফেটে পড়ত। তিতির বলে উঠল, “মা, এখানে একটু বোসো।”
কী শান্ত ওর গলার আওয়াজ! সুতপা যন্ত্রচালিতের মতন তার পাশে গিয়ে বসল। তিতির ওর ছোট হাতটা সামনের দিকে তুলে বলল, “মা দ্যাখো। ওই নীলপাখীটা। ও জানে বাবা কোথায়। ওর সাথে ভগবানের রোজ দেখা হয়, বাবা বলেছে। মা? ভগবান মানে কী বলো তো?”
সুতপা আর সহ্য করতে পারছিল না। কোনরকমে মুখ তুলে তিতিরের মুখের দিকে তাকাল।
“ভগবান মানে ভালবাসা। কেউ দেখতে পায় না। সবাই বুঝতে পারে। বুকের মধ্যে। বাবা বলেছে। ওই পাখীটাকে ভগবান পাঠিয়েছে যাতে মানুষ ভালবাসতে না ভুলে যায়, তাই জন্য। তাই না মা?”
সুতপা চকিতে উঠে তিতিরকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। সমীরের থাকা, না থাকা সব মিলিয়ে তার কাছে ঝাপসা। যেন থাকাটাই খুব বেশী। তিতির শান্ত হয়ে তার মা’কে জড়িয়ে থাকে। সুতপাও কিছুক্ষণ পরে বেশ কিছুটা শান্ত হয়। ঝাপসা চোখে দেখল নীলপাখীটা উড়ে পূবদিকের নীল আকাশে ধীরে ধীরে লীন হয়ে গেল। সুতপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল। সমীরকে সে অনুভব করতে পারছে। তার সমস্ত সত্তা তিতিরে, আকাশে, বাতাসে, তার নিজের মধ্যে...। সে মনে মনে বলল, সমীরের শেখানো,
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ ---
সমীর আছে।
(ছবিঃ সুমন)