এমন একটা লেখা লিখুন যাতে কেউ বুঝতে না পারে। মানুষ সহজে বুঝলে সহজে ভুলে যায়। সহজে পেলে মান কম দেয়। সহজ না, জটিল কিছু লিখুন।
এইবার? এই যে এতবড় জটিল পৃথিবী, এত এত প্যাঁচাল, এত এত ঝুটঝামেলা, এই কি শেষ? না তো। এক মেলা লোক। হাজার রকম আলো, হাজার রকম মানুষ, হাজার রকম আমোদ, সমস্যা, ব্যবসা, উদ্দেশ্য। এ সবের শেষে কি থাকে? ভাঙা মেলা। তারপর শূন্য মেলা।
যে ট্রেন হিল্লিদিল্লি ঘুরে এত এত রাস্তা পেরিয়ে যাত্রা শেষ করল, তাকেও কারশেডে গিয়ে বিশ্রাম করতে হয়।
যে মানুষটার দোকানে গিয়ে মাঝে মাঝে আমরা ফুলুরি খেতাম, চা খেতাম, সে মানুষটাকে আজ দোকানে গিয়ে দেখলাম বড় একটা ছবি হয়ে হাসি মুখে দেওয়াল থেকে আমার দিকে তাকিয়ে। হুস করে তার জীবন্ত হাসিমুখটা মনে পড়ল। বিহারী টানে বাংলা ভাষা মনে পড়ল। লুঙ্গিটাকে হাঁটুর উপর তুলে আলু কাটা মনে পড়ল, সকালে পুরী তরকারি হবে যে! রেলের কারখানায় ঢোকার আগে সব খাবে।
একদিন বললেন, আমিও রেলে চাকরি পেয়েছিলাম.... ছেড়ে দিলাম... ধুর ভালো লাগল না।
কথা সত্যি। কিন্তু ক্ষোভ নেই কেন কথাটায়? এই তো ছোটো দুটো ঘর। সামনে এক চিলতে দোকান। সকালে পুরী-তরকারি। রাতে ফুলুরি-চা। চা অবশ্য সারাদিনই। পোশাকও তো দেখি সারা বছর এক। শীতে শুধু ময়লা কালো চাদর একটা। তবে? তোমায় বানানোর সময় ক্ষোভ দেয়নি রামজী তোমার? 'রামচরিতমানস'-এ পড়েছি তো, রামজী বলছেন ভক্ত হতে গেলে মনে সন্তোষ আর অকপট হলেই হয়। তুমি তবে রামচরিতমানস অনুযায়ী ভক্ত। তোমায় বানাতে গিয়ে ক্ষোভ দিলেন না রাম। আমাদের তো এত এত ক্ষোভ। যত বেশি জানি তত ক্ষোভ জন্মায়। অহং-এর ওজন যত বাড়ে মাটির উপর গেড়ে বসার তাগিদ তত চাপে।
জিজ্ঞাসা করলাম, কি করে হল? ছেলে চা বানাচ্ছিল। বলল, পেসমেকার বসাতে গিয়ে হার্টফেল করল।
কোথায়?
কলকাতার এক নামী বেসরকারি নার্সিংহোমের কথা বলল।
ছেলে বলল, বারো লাখেও বাঁচানো গেল না। আমরা তিন ছেলে রেলে চাকরি করি, তাও বাঁচানো গেল না। ওঁর জন্য কিচ্ছু করতে পারলাম না আমরা। সারাটা জীবন শুধু আমাদের জন্যেই বাবা করে গেলেন, ওই লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন....
দূরে ছটপুজোর গান হচ্ছে। মাথায় কমলা সিঁদুর পরে মহিলারা উৎসবে মজে আছে। উৎসবের কত দিক। এক সিঁদুরেরই কত রঙ!
বললাম, খুব ভালো মানুষ ছিলেন আপনার বাবা....
ছেলে চকচকে চোখে তাকিয়ে, কাঁপা ঠোঁটকে শাসন করে বলল, তাই তো ভালো আছি আমরা....
ফিরে আসছি এবার। মৃত্যুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। সে জীবনের পায়ে নত হয়ে। সন্তোষ পরম ধন। সে ধন বই পড়ে পাওয়া যায় না। হাজার জন্ম তপস্যা করলেও পাওয়া যায় না। সন্তোষ পাওয়া যায় সন্তোষের কাছেই। যে জীবনে সন্তোষ আছে সে-ই পারে সন্তোষের শান্তিবারি দিতে। সে বুকে জন্মায় না। মাথায় জন্মায় না। মেধায় জন্মায় না। পাণ্ডিত্যে তো আরো জন্মায় না। জন্মায় সঙ্গে। সৎসঙ্গে। এমন মানুষের সান্নিধ্যে যে মানুষ সংসারকে ছায়া দিয়ে দাঁড়িয়ে। সে ধনী নয়?
আমার কলম এই কয়েকটা জীবনের কথাই লিখে রাখুক। মূল্য যদি চাই, সে নিজের চিত্তের প্রসাদ। আর কি? গঙ্গায় না নামতে পারি, গঙ্গার শীতল হাওয়া তো পাড়ে দাঁড়িয়েও মাখতে পারি।