মহালয়ার দিন। গঙ্গার ঘাটে প্রচণ্ড ভিড়। বাবা তর্পণ করতে যাবেন। সঙ্গে আমিও গেছি। কারণ, বাবা স্নানে নামলে কাপড়জামা, চটি পাহারা দিতে হবে। বাবাকে দেখছি আগের দিন রাতে একটা মোটা বই থেকে কি সব লিখছেন। বইটা খুব সম্ভবত 'পুরোহিত দর্পণ'। ঠাকুর্দার বই। বইটার প্রায় নির্বাণ প্রাপ্তির সময় এসে গেছে, এতই ছেঁড়া।
`যা হোক, বাবা আর আমি রিকশায় বসে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছালাম। বেজায় ভিড় আগেই বললাম। এক একজন পুরোহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে দশবারোজন অর্ধনগ্ন পুরুষ। হাতে জল নিয়ে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন। তারাও পড়ছেন। আমার একবার মনে হল, ক্রস কানেকশন হয়ে যায় যদি? মানে একজনের বাবা কি মায়ের উদ্দেশ্যে দেওয়া জল, পুরোহিতের তাড়াহুড়োতে কিম্বা তর্পণকারীর শ্রবণ ভুলে আরেকজনের কাছে চলে যায় যদি?
যা হোক, এদিকে তো বাবা ধুতি পরে, তিল, কুশ, কোশাকুশি নিয়ে তৈরি। হাতে ধরা কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তুই পড়ে যাবি, আমি যা করার করে যাব।
আমি মহা ফাঁপরে পড়লাম। বললাম, ইয়ে মানে, তুমি তো আছও এখনও.... আমার পড়া মানে...
বাবা চোখ পাকিয়ে বললেন, মুখে মুখে পড়বি... মন থেকে পড়বি কেন....
যা হোক। সব মিটল। বাড়ি এলাম। বাবা খেতে বসলেন। জলের বোতল এগিয়ে দিতে গিয়ে ঠেক খেলাম মনে। বাবাকে জল দিতে মন্ত্র লাগছে না।
যে মানুষটার এই জল দেওয়ার সুযোগটা আর নেই, সে হয় তো নিজেকে বঞ্চিত করবে না বলেই জল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে? জল দেওয়ার প্রয়োজনটা তত বড় নয়, জল দেওয়ার ইচ্ছাটা যত বড়? তাই কি? হয় তো সব জায়গায় তা নয়। অনেক জায়গায় খুব যান্ত্রিক, খুব শুষ্ক প্রাণহীন অনুষ্ঠান। কিন্তু সবার হয় তো নয়। নাড়ির যোগকে, প্রাণের যোগকে ছাড়ব বললেই কি ছাড়া যায়? তাই শরীরের বন্ধন মুক্ত হলেও প্রাণের টান মুক্ত হয় না।
আমি তর্পণে বিশ্বাসী নই। কিন্তু মানুষের প্রাণের সব নির্দোষ আবেগকে গভীর থেকে শ্রদ্ধা করি। ভাগবতে যখন কৃষ্ণের মাধুর্য বর্ণনা করতে করতে দিশা পাননা কবি, তখন আমার কাছে আস্তিকতা, নাস্তিকতার তর্ক বড় হয় না, আমার কাছে বড় হয় এই ভীষণ নিষ্ঠুর ক্ষমাহীন জগতে মানুষ যে একটা মাধুর্যকে খুঁজে পেয়েছে নিজের চিত্তে, সেই, সেই অনেক বড় কথা। মানু্ষের সব থাকলেও, মাধুর্যটুকু হারিয়ে গেলে সব হারিয়ে যায়। যার প্রতিদিন সকাল হলেই মনে হয়, আমার এই নেই, সেই নেই, আমি এই হইনি, সেই হইনি - তার মত দুর্ভাগা পৃথিবীতে দুটো নেই। এত বড় জগত তার কাছে এক দীর্ঘশ্বাসেই শেষ হয়ে যায়। কোথাও এতটুকু শান্তি নেই তার।
আর যার সকালটা শুরু হয়, অভাবে না, মাধুর্য দিয়ে, তার অভাব থাকলেও সে সার্থক। নিজের চিত্তের মাধুর্যে।