স্থান, দার্জিলিং। সময়, বিকেল। আবহাওয়া, মেঘলা। তিনটে গাড়ি এসে থামল সিস্টার নিবেদিতার বাড়ির সামনে। চারদিকে কেউ নেই। ফাঁকা ফাঁকা। কুয়াশা ঘেরা বাড়িটাকে অদ্ভুত লাগছে। একটু পর দু একজনকে দেখা গেল। বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠছি নামছি। লেখা পড়ছি। ছবি দেখছি। ঘরের মধ্যে বেশ একটা পুরোনো পুরোনো গন্ধ। দেওয়ালে টাঙানো একটা কিছু পড়ছি, হঠাৎ আরাধ্যা আমার পিছনে এসে দাঁড়ালো। তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, নিবেদিতা আন্টির গান শুনলাম।
ঘরের মধ্যে আধো অন্ধকার, আলো। তায় কুয়াশা ঢুকছে। তার মধ্যে অমন দৃঢ় নিশ্চয় কণ্ঠস্বরের ঘোষণা, "নিবেদিতা আন্টির গান শুনলাম"... আমার পিলে চমকে উঠল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কই?
আরাধ্যা আমার হাত ধরে একটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল। কয়েক ধাপ পেরোতেই কানে এলো এক মহিলা কণ্ঠস্বর, হারমোনিয়ামের আওয়াজ। সরগম অনুশীলন করছেন কেউ। সিঁড়ির আরেকটা বাঁক ঘুরতেই সামনে বারান্দা, তার ও প্রান্তে একটা বড় হল ঘর মতন, একজন মহিলা চোখ বন্ধ করে গলা সাধছেন।
আরাধ্যা আমার দিকে তাকিয়ে, আরো গম্ভীর হয়ে বলল, ওই যে নিবেদিতা আন্টি।
আমার আর দাঁড়াবার অবস্থা থাকল না। আমি আরাধ্যাকে পাঁজাকোলা করে তুলে সটান বাইরে এসে দাঁড়ালাম। হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরে যাওয়ার জোগাড়। সে বেচারি বিভ্রান্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু তাকে বোঝাই সে অবস্থা আমার নেই।
আসলে সারাটা গাড়ি এত গাম্ভীর্যতার সঙ্গে 'নিবেদিতা' নামটা শুনতে শুনতে এসেছে। এসেই দেখে সবাই মিলে 'নিবেদিতা আন্টি'কে উপেক্ষা করে তাঁর বাড়ি দেখতে মশগুল। এটা নিশ্চয়ই ওর কাছে খুব অশোভন ঠেকেছে। তাই আমাকে নিজের থেকে উপযাচক হয়ে এসেই বলল, নিবেদিতা আন্টির গান শুনলাম, তুমিও শুনে এসো।
সত্যিই যদি হত। নিবেদিতা কি খুশীই না হতেন, এমন এক পুচকে, এত এত কিছু শিখে গেছে স্কুলে গিয়ে। তাঁর বাগবাজারের স্কুলের গল্প বলতেন। পুরাণের গল্প বলতেন। নানা দেশের নানা বীর সন্তানদের গল্প বলতেন। কুয়াশা এসে ঘিরে বসত। গল্প বোনা হত প্রাচীনে নবীনে একাকার হয়ে। কি দারুণই না হত।
সে যা হোক, তবে আমার এখনও মাঝে মাঝেই আরাধ্যার গলার আওয়াজটা কানে বাজে… কুয়াশা ঘেরা আলো আঁধারি ঘর… তার মধ্যে এক স্পষ্ট, নির্দ্বন্দ্ব উচ্চারণ … "নিবেদিতা আন্টির গান শুনলাম"।
হাতে দাও
========
আলেখ্য বুঝতে শিখেছে জগতে দু ধরণের বস্তু আছে। এক, যা তার নাগালের মধ্যে, দুই, যা তার নাগালের বাইরে। নাগালের বাইরে কোনো আগ্রহব্যঞ্জক বস্তু দেখলেই সে এখন বলে, হাতে দাও। মধুর শিশি, হাত ঘড়ি, চামচ, নানাবিধ শোপিস, বই, ছবি, সন্দেশ, চিকেন… সবই "হাতে দাও"। তবে এই জগতে মনুষ্য সৃষ্ট সব চাইতে উৎকৃষ্ট বস্তু সে আবিষ্কার করেছে, কাগজের কাপ। তাই অনেক ছবিতেই তাকে কাপহস্তে দেখা যায়। এখানেও একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে।
তো হল কি, আমরা দু’জনে চিড়িয়াখানা ঘুরছি দার্জিলিঙে। দু’জন ঘুরতে পা লাগছে একজোড়া। আরেক জোড়া খুদে খুদে দুটো পা আমার দেহ সংলগ্ন হয়ে ঝোঝুল্যমান। বাঘটাঘ দেখে তিনি খুব একটা খুশী হলেন বলে মনে হল না। কটা হনুমান দেখে বেজায় খুশী হলেন। কিন্তু সমস্যাটা হল অ্যাকোরিয়ামের কাছে এসে। অমন রঙবেরঙের মাছ চোখের সামনে টুলটুল করে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। তিনি তো নাক চোখ কাঁচের সঙ্গে ঠেসে ধরে দেখছেন। মাঝে মাঝেই উৎসাহিত হয়ে বলছেন, মাছ মাছ। এ অবধিও ঠিক ছিল… হঠাৎ বললেন, হাতে দাও। সারা চিড়িয়াখানা ঘুরে উনি উপলব্ধি করেছেন, বাঘ হনুমান পাখিটাখি হাত ছাড়া করলেও চলে। তারা যে তার মুঠোর মধ্যে আসবে এমন একটা ভরসাও তিনি পাননি বলেই মনে হল। কিন্তু মাছগুলো? এমন আবদ্ধ জলে যদি এমন নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারে, তবে তার হাতের মধ্যে আসতেই বা তাদের আপত্তি কোথায়?
তাকে যদি বলি ওরে ও হাতে নেওয়া যায় না… তার কণ্ঠস্বরের পারা চড়তে থাকে। আমার এমন অবিবেচকের মত কথা যেন সে জন্ম ইস্তক আর একটাও শোনেনি। বড় বড় চোখ করে হাত পাকিয়ে খালি বলে, হাতে দাও….
শেষে আমার উদ্ধারকর্তা হয়ে এলো আরাধ্যা। সে তার কচি দুটো হাত বাড়িয়ে বলল, আয় ভাই…. ওদিকে কি দারুণ কাঠবেড়ালি…. আয় আয়…
কোলান্তর ঘটল। কাঠবেড়ালি অবধি অবশ্য পৌঁছানো গেল না। তার আগেই পুচকে দিদির চোখ আটকেছে পাশের খাঁচায় রাখা এক বিচিত্র প্রাণীর দিকে। আর আলেখ্যও কাঠবেড়ালি ভুলে খাঁচার দিকে আঙুল তুলে বলছে… দিদি… দিদি…
মানে ওদিক চল… ওদিকে চল….