(কিছু ঘটনা শোনার পর থেকে বিঁধে থাকে, যতক্ষণ না ভাষায় জন্মায়)
আজ দোকানটা খোলেনি। অবশ্য এখন দোকানটা খুললে না খুললে তেমন কিছু আসে যায় না।
বলাইয়ের বাবা স্বর্গীয় বীরেশ্বর পালের এই মুদির দোকান – ‘শ্রীলক্ষ্মী ভাণ্ডার’-ই ছিল সব চাইতে চালু দোকান। তখন শ্যামনগরের এদিকটা গ্রাম, কয়েকটা মাত্র পাকা বাড়ি। দিনে দিনে জনবসতি বাড়তে লাগল। ‘শ্রীলক্ষ্মী ভাণ্ডার’-এর খদ্দের সংখ্যা কমতে শুরু করল। আসেপাশে রোজই একটা করে দোকান খুলছে। নতুন সাজানো গোছানো দোকান সব। বলাইয়ের অত পুঁজি ছিল না যে দোকানটা নতুন করে সাজাবে, আর বরাবরই বলাই একটু অলস প্রকৃতির।
এখন দোকানে শ্রী বলতে কিছুই নেই। কয়েকটা অর্ধেক খালি বয়াম, এখানে সেখানে ঝুল, গণেশ-লক্ষ্মীর মালা বদলানো হয় মাসে একবার, ধুলো জমে থাকে। বলাইয়ের সংসার বলতে তার স্ত্রী মনোরমা আর মেয়ে চুমকি, ক্লাস নাইনে পড়ে। বলাইয়ের বয়েস এখন প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। শান্ত মানুষ। কারোর সাতে-পাঁচে থাকে না। সকাল সাড়ে আটটায় দোকান খোলে। দুটোয় বন্ধ করে। দুপুরটা ঘুম দেন টানা চারটে অবধি। সাড়ে চারটের সময় আবার দোকান খোলে, রাত এগারোটা অবধি খোলা রাখে। চুমকি পড়াশোনায় খুব একটা ভালো নয়। বলাই বা মনোরমা দু'জনেরই পড়াশোনা ক্লাস এইট পর্যন্ত। চুমকির বেশিরভাগ সময় কাটে টিভি দেখে। বলাই, মনোরমা অত জোরাজুরিও করে না, মেয়ে যখন যাই পড়ুক হিল্লে হয়ে যাবে, এরকম একটা মনোভাব দু'জনেরই।
আজ মেন রাস্তার উপর সন্তোষদের একটা চারতলা শপিংমল খুলছে। তার নেমন্তন্ন, পুরো পরিবারের। আজকাল নেমন্তন্নবাড়ি বলাই আর মনোরমা দু'জনেই এড়িয়ে যায়। উপহারের খরচ কুলিয়ে ওঠা যায় না, আর যা তা তো একটা দেওয়াও যায় না বাড়ির সম্মানের কথা ভেবে। একটা ভালো শাড়ি কিনতেই যা খরচ হয় তাতে চুমকির দুটো টিউশানির টাকা চলে যায়। "শরীর ভালো না", "মেয়েটাকে পড়তে নিয়ে গিয়েছিলাম", "আজ আমাদের বাইরে খাওয়া নিষেধ গুরুর আদেশে" – এরকম নানা অজুহাতে এড়িয়ে যায় দু'জনেই। সবাই জানে ব্যাপারটা, তাই এই নিয়ে অনেকেই কিছু প্রশ্ন করে না বলাইকে, আবার অনেকে প্রশ্ন না করলেও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয় যে তারা আসল কারণটা জানে, মজাও করে। সেটা দু'জনেই বোঝে, তবু অতীত দিনের একটা ঘোর থেকে বলাই বেরোতেই পারল না, তার এখনও মনে হয় এটা একটা দুঃস্বপ্ন, কেটে যাবে। মনোরমা সেটা বিশ্বাস না করলেও ভাগ্যের এই অবস্থাটা মেনেই নিয়েছে। মনোরমা বাড়ির অমতেই বিয়ে করে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তার একমাত্র দাদা পরিতোষ তাদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে না। এমনকি চুমকি রোজ তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে যায়, পড়তে যায়, তার সাথেও দুটো কথা বলে না। এই তো পাশের দুটো পাড়ার পরেই থাকে।
চুমকিকে আজ স্কুলে যেতে দেয়নি বলাই। বাড়িতে ভালো রান্না বলতে মাসে একদিন মাংস। তাও তিনটের জায়গায় মেয়েটা চারটে পিস খেতে চাইলে নিজেদের কারোর পাত থেকে তুলে দিতে হয়। আজকাল বড় হচ্ছে তো, দুটো পিস হলেও চুপ করে খেয়ে উঠে যায়। টিভি চালিয়ে বসে। বলাই পুরোনো দিনের স্বপ্নে নিজেকে ডুবিয়ে বাকি ভাতটা খেয়ে উঠে যায়, আর মনোরমা যন্ত্রের মত খেয়ে উঠে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকে, বলাইয়ের খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায়, ন্যাতা দিতে হবে।
দুপুরেই নেমন্তন্ন। শপিংমলটা যখন শুরু হয়েছিল, বলাই ভিতপূজোর দিন দেখতে গিয়েছিল। এতবড় হবে ভাবতে পারেনি। শুনেছিল নীচের তলায় নাকি মুদির সব জিনিস অল্প দামে পাওয়া যাবে। পাড়ার আশেপাশের দোকানদারদের মধ্যে একটা প্রতিবাদ উঠেছিল। বাড়তে পারেনি। সন্তোষের সাথে মোকাবিলায় আসা যায় না, ওর হাত সেই মুখ্যমন্ত্রী অবধি। ওর বউ এখানকার কাউন্সিলার। বলাই এই নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামায়নি, তার যারা খদ্দের তারা ওই শপিংমলে ঢুকতে ভয় পাবে। তাছাড়া সেখানে তো আর ধারে জিনিস দেওয়া হয় না। ওরাই তো তার বাঁধা খদ্দের এখন। তবে কার্ডটা ভালো করেছে। একটা গণেশের মাটির মূর্তি কার্ডের গায়ে লাগানো। ভিতরে নানা রঙে ইংরাজিতে লেখা। দুপুর এগারোটায় লাঞ্চ, এই কথাটায় বলাইয়ের চোখ আটকে যায়। আশেপাশে কোনো দোকানির সাথে আলোচনাও করেনি, ওরা ভালোভাবে নেবে কি নেবে না, তাছাড়া যাবেও না হয়ত অনেকেই।
মনোরমা দশদিন ধরে ভেবে যে শাড়িটা অবশেষে পরল সেটাতেও মনটা খুঁতখুঁতই করতে লাগল। চুমকি তার লাল পূজোর ফ্রকটা পরল, এটা তার সবচাইতে প্রিয়, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিনদিনই এইটা পরেই কাটিয়েছে, বাকিগুলো নাকি ম্যাড়মেড়ে লেগেছে, মিথ্যা বলেনি মনোরমা জানে। বলাই একটা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরেছে, কাচা, কলারের কাছটায় কালো রঙটা ওঠে না আজকাল শুধু।
রাস্তায় নামার পর আজ অনেকদিন পর বেশ গর্ব লাগছে বলাইয়ের। ঠিক গর্ব না, একটা আত্মতুষ্টি বলা চলে। দরজায় তালা দিয়ে তালাটা টেনে দেখল, বাবার মত। একটা টোটো নিল, শপিংমলটা যদিও বেশিদূর নয়, অন্যদিন এর থেকে দূরেও হেঁটেই যায়, তবে আজ না। মানিব্যাগে তিনশো টাকা আজকের দিনটার জন্যেই সরিয়ে রেখেছিল বলাই। সিনেমায় যাবে ঠিক করে রেখেছে ওখান থেকে সরাসরি। খেতে খেতে চারটে তো বাজবেই, সাড়ে চারটের শো, ঠিক পৌঁছে যাবে।
শপিংমলে থিকথিক করছে ভিড়। সব দোকানিরাই এসেছে, এরা কি ভণ্ড, বলাই মনে মনে বলল, খাওয়ার ছুতো কেউ ছাড়বে না। জোরে একটা হিন্দিগান বাজছে। মনোরমা সবার সাজগোজ দেখতে দেখতে ভুলেই গেছে তার আঁচলের দিকটা চেপে ধরে রাখতে হবে, বিচ্ছিরি স্পট পড়েছে একটা। চুমকি এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করছে, মা খাওয়াটা কোন দিকে গো? বিরিয়ানি করেছে? সেই মামাবাড়ির গৃহপ্রবেশে আমরা শেষবার বিরিয়ানি খেয়েছিলাম, মনে আছে? মনোরমার পরিতোষের মুখটা মনে পড়তেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো, ও আসেনি তো? একটা অসহায়ের মত অভিমান হবে ওকে দেখলেই আবার।
চা আর স্ন্যাক্স নিল বলাই আর মনোরমা। চুমকি কিছু নিল না। বলাইয়ের একটা খটকা লাগছে, চারতলা তিনবার ঘুরে দেখে এলো, কোথাও খাওয়ার জায়গা তো দেখল না। এগারোটা চল্লিশ বেজে গেল। অনেকেই না খেয়েই বেরিয়ে যাচ্ছে। বলাই কার্ডটা সাথে করেই এনেছে, একবার একটু আড়াল করে খুলে দেখল, না এই তো লাঞ্চ এগারোটায় লেখা, তবে? প্যাকেট দিচ্ছে কি কোথাও? বাইরেটাও ঘুরে এল, না তো! বাইরে গাড়ির ভিড় সার দিয়ে। এদিকে চুমকি বারবার জিজ্ঞাসা করছে কখন খাওয়াবে, কখন খাওয়াবে। মনোরমা তার মুখের দিকে একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকাচ্ছে, মেয়েটা শুধু কমপ্ল্যান খেয়ে এসেছে, ওর বদ্ধমূল ধারণা আজ বিরিয়ানি হবে, কারণ ওর সব বন্ধুরা যেখানেই নেমন্তন্ন খেয়ে আসে সবাই বলে নাকি বিরিয়ানিই খেয়েছে।
বলাই আর অপেক্ষা করতে পারছে না। একটা কুড়ি। সন্তোষকে একা পাচ্ছে না যে জিজ্ঞাসা করে। এমন সময় সন্তোষ টয়লেটের দিকে যাচ্ছিল, বলাই খপ্ করে হাতটা চেপে ধরল টয়লেটের দরজাতেই, "ভাই খাওয়ানোর জায়গাটা তো পাচ্ছি না!"
সন্তোষ 'হাঁ' করে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ বলাইয়ের মুখের দিকে, তারপর কড়ে আঙুলটা দেখিয়ে বলল, এক মিনিট, আসছি। সন্তোষের হাই সুগার। বলাই শুনেছিল, হঠাৎ মনে পড়ে গেল। অস্থির লাগছে। সন্তোষ বেরোলো। বলাই এখনও দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে, সন্তোষ বলল, খাওয়া? কিসের খাওয়া?
বলাইবাবুর হাত-পা কাঁপছে, কেউ আসছে এদিকে? না... পাঞ্জাবির পকেট থেকে বহুবার পড়া কার্ডটা বার করে লাঞ্চের জায়গায়টায় হাত দিয়ে দেখাল, এতবার পড়েছে যে না তাকিয়েই হাতটা ঠিক ওইখানেই গিয়ে পড়ল – LAUNCH AT 11.00 AM
সন্তোষ 'হো হো' করে হেসে উঠে বলাইবাবুর পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, তুমি ঠাট্টাও জানো মাইরি, আরে এটা সেই লাঞ্চ নয়... এটা লঞ্চ... launch… আর ওটা lunch…
বলাইয়ের প্রথমেই চুমকির মুখটা মনে পড়ল। সন্তোষ ভিড়ে মিশে গেছে ততক্ষণে। তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কিছু বলছে কি বন্ধুদের... সবাই কি হাসছে... বলাইয়ের চোখদুটো মুহূর্তে লাল হয়ে গেল, যন্ত্রের মত মনোরমার সামনে দাঁড়ালো, মনোরমা কি বুঝল জানে না, সে বিদ্যুৎগতিতে চুমকিকে টেনে নিয়ে বড়রাস্তায় এলো। বলাই একটা টোটোয় উঠে বলল, ‘খাস বিরিয়ানি’ চলো। এই তল্লাটের মোটামুটি চালু দোকান। চুমকি প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েও এখন আবার বিরিয়ানির কথা শুনে খুশী হয়ে রাস্তার লোক দেখছে। বলাই কারুর মুখের দিকেই তাকাচ্ছে না। চুমকি বিরিয়ানি খেলো, আর তারা দু'জনে এক প্লেট চাউ হাফ করে খেয়ে বাড়ি এলো। বলাই সাড়ে চারটেতেই দোকান খুলল। মনোরমা মাথা ধরেছে বলে শুয়ে থাকল, অম্বল হয়েছে সত্যিই।
বলাই বেশ রাত করে বাড়ি এল। চুমকি টিভি দেখছে, রাতে কিছু খাবে না, পেট ভরতি। বলাই চুমকির পাশে বসে ওর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, লাঞ্চ বানান কি রে মা? চুমকি বলল, এল ইউ এন সি এইচ...
বলাই ওর মাথায় মুখটা গুঁজে ওকে জড়িয়ে ধরল। চুমকি বলল, তুমি কাঁদছ?