Skip to main content

সুজন ক্ষ্যাপা যাকেই দেখত, তাকেই জিজ্ঞাসা করত, হ্যাঁ গা, ঈশ্বরের শ্বশুরের নাম কি গো?

আসলে এর একটা ইতিহাস আছে। সুজনের যখন বিয়ে হয় ময়নার সঙ্গে, তখন সে ছিটেল ছিল। এমন ক্ষ্যাপা হয়ে ওঠেনি। মাছের ব্যবসা ছিল। এমন বড় কিছু নয়। তবে গ্রামেগঞ্জে যেমন হলে চলে যায় তার চাইতে বেশিই ছিল। কিন্তু হলে কি হবে। ওদের বংশে নাকি পঁয়তাল্লিশ পেরোলেই সব পাগল হয়। ওর বাবা নাকি সারাদিন নারকেল গাছে চড়ে আকাশে রঙ করত। বলত, আকাশে নাকি আগের মত জেল্লা নেই। সুজনের ঠাকুর্দা পুকুরে ডুবে মাছের সঙ্গে কথা বলত। বলত সে ভাষা জানলে নাকি আর মানুষের ভাষা ভাল্লাগে না। অগত্যা সুজন যে পাগল হবেই তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে?

তবে কথা হচ্ছে সুজন ঈশ্বরের শ্বশুরকে খোঁজে কেন? কারণ হল সুজনের শ্বশুর। রাধাকান্ত সামন্ত। সুজন ক্ষ্যাপা হলে কি হবে, ময়নাকে ভালোবাসত ভীষণ। সেই ময়নাকে রাধাকান্ত উকিল দিয়ে বাড়ি শুধু নিয়ে গেল না, সুজনের যাবতীয় সম্পত্তিও ময়নার নামে করে, সুজনকে ঘর ছাড়া করালো। সুজন সেই থেকে বিশ্বাস করে জগতে সব অনর্থের মূলে ঈশ্বর নয়, ঈশ্বরের শ্বশুর।

======

একদিন সুজন নদীর ধারে বসে আছে। ভিক্ষা করে ফিরছে অনন্ত বৈরাগী। অনন্ত বৈরাগী আসলে ভিখারি নয়। সাধনার জন্য কয়েক বাড়ি ভিক্ষা করে। গুরুর নির্দেশ। এমনিতে অনন্তের মোবাইল সারানোর দোকান। স্টেশানের ধারেই দোকান।

অনন্তের সেদিন মন খারাপ। মোবাইলের দোকানে চুরি হয়েছে। চোর কে জানে। নিজেরই শালা। নেশাখোর। অনন্ত ভগবানকে অতটা ভয় করে না, যতটা কাত্যায়নীকে পায়। কাত্যায়নী অনন্তের বউ।

অনন্ত বসে পড়ল সুজনের পাশে। সুজন বলল, দাদা, ঈশ্বরের শ্বশুর কে বলো তো?

অনন্ত বলল, আমি কি হাত গুনতে জানি রে? সে জানে আমার শ্বশুর। যদি যাস, এখনিই জানিয়ে দেবে।

সুজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকল অনন্তের দিকে। খানিকবাদে বলল, মাইরি বলছ!

আসলে অনন্তের আজ কাউকে ঠকাতে ইচ্ছা করছে। এই প্রতিশোধ। সুজন দাঁড়িয়ে পড়েছে। অনন্তের বুকের উপর আঁচড় কাটছে সুখ। কাঁটাসুখ।

সুজন বলল, তার বাড়ি কোথায়?

অনন্ত বলল, এই আমাদের গ্রাম তেঁতুলপোড়া। এরপর সুখীপায়রা, কালোহাঁড়ি, জগচখা, তারপর ডালখালি। সেখানে গিয়ে বলবি ভল্লা দাসের বাড়ি। গেলেই হবে।

সুজন লাফ দিয়ে উঠল। খামচে অনন্তের হাতটা ধরে বলল, এখনই চলো না দাদা….

অনন্ত বলল, ধুস, আমি জামাই, যখন তখন যেতে পারি?

সুজন হাতটা ছেড়ে বলল, সেও তো। আমিও তো জামাই, জানি জানি। ঠিক আছে। আমি একাই যাচ্ছি। কি নিয়ে যাই বলো তো?

অনন্ত বলল, কি আর নিয়ে যাবি? দুটো পেঁপে নিয়ে যা।

======

দুটো পেঁপে নিয়ে যখন সুজন ডালখালি গ্রামে পৌঁছালো তখন দুপুর। খিদেতে পেট টনটন করছে। একটা পুকুর দেখতে পেয়ে সুজন হনহন করে পুকুরে নেমে কয়েক আঁজলা জল খেল। তারপর রাস্তায় একে তাকে জিজ্ঞাসা করে ভল্লা দাসের বাড়ি কোথায় বলতে পারো?

ভল্লা দাসের নাম যেই শোনে সে-ই রাস্তা বদলায়। এড়িয়ে যায়। আর যাবে নাই বা কেন? দিনের বেলায় ভল্লা দাসের বাড়ি খোঁজে এমন বুকের পাটা এই গ্রামে কেন, পাঁচশো ক্রোশ দূরেও কারোর নেই। তেরোটা খুন, পঞ্চান্নটা ডাকাতির মামলা ভল্লার নামে।

যা হোক, দৈবের জোরেই হোক আর কাকতালীয়ভাবেই হোক, ভল্লা দাসের মাসি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল হরেনের মুদির দোকানে গুড়াকু কিনবে বলে। সকাল থেকে পেটটা পরিষ্কার হয়নি। ভল্লার মাসি ভল্লাকে যারপরনাই স্নেহ করে। ভল্লার খুনের কথা, ডাকাতির কথা উঠলেই বলে, আহা ভল্লা আমার ছোটোবেলা থেকেই এমন দুষ্টু। কেন তোমাদের মন নেই, ওর জন্যে তোমরা গাছে আমটা, কলাটা রাখতে পারতে না। বাড়িতে কারোর মুরগী কি ছাগল পোষার জো ছিল? তবে? তো দুষ্টু ছেলে আমার ভল্লা, কিন্তু মনটা? দেখো কি নরম। যেন তুলোর পেঁজা।

তো সেই মাসি, এমন দিনদুপুরে কেউ ভল্লাকে খুঁজছে দেখে তো আনন্দে আত্মহারা। গুড়াকু ভুলে সুজনকে একরকম পাঁজাকোলা করেই নিয়ে গেল ভল্লার বাড়ি।

======

ভল্লা তখন সদ্য ঘুমাতে গেছে। ঘুম আসব আসব করছে। মাসি তাকে বিছানা থেকে তুলে এনে সোজা বসার ঘরে সুজনের সামনে এনে দাঁড় করালো। অবশ্য এ ক্ষমতা মাসি ছাড়া আর কারই বা আছে।

ভল্লা বসল সোফায়। সুজন বসে মেঝেতে। ভল্লা বলল কি চাই?

সুজন হেসে বলল, আজ্ঞে দুটো রুটি আর একটা উত্তর।

ভল্লা বলল, রুটি দেওয়া হচ্ছে, কি প্রশ্ন?

আজ্ঞে ঈশ্বরের শ্বশুরের নাম কি?

ভল্লা ভুরু কুঁচকে ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, মাসি, কি যেন নাম ছিল গো… এই তো আশ্বিনেই মারা গেল না…. কুকুরে কামড়ে….

মাসি বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ও মিনসেকে আমি আর চিনি না…! বয়েসকালে কম জ্বালিয়েছে! হারাধন বারুই।

সুজনের চোখ ছলছল করে উঠল। বলল, উনি মারা গেছেন!

মাসি এগিয়ে এসে সুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ বাবা… কেঁদো না…. বড় বদলোক ছিলেন….

সুজনের মাথায় এমন করে কেউ কোনোদিন হাত বুলায়নি। সে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, আমার সংসারটা…

মাসি বলল, সে মিনসে যে কত সংসার ভাসিয়েছে…..

ওদিকে তখন সোফায় এলিয়ে ভল্লা নাক ডাকছে।

======

সুজনকে মাসি আর ছাড়ল না। ভল্লাও আপত্তি করল না। সুজন সারাদিন বাগানে খাটে। মাসির সঙ্গে বাগানে কাজ করে। মাসি বাগানে গাছ লাগায়, পছন্দ না হলেই সব গাছ তুলে দেয়। কেন পছন্দ হল না সে প্রশ্ন কেউ করে না। সুজন খালি বোঝে। কি করে বোঝে জানে না। কিন্তু বোঝে। যখনই কোনো গাছ ফুল দিতে শুরু করে, ফল দিতে শুরু করে মাসি সে গাছ কেটে দেয়। আবার নতুন করে লাগায়।

আসলে এই বাগানের ফুল ফল কেউ নেয় না। বলে, ও পাপের টাকায়। মাসির কষ্ট হয়। সুজন স্পষ্ট বোঝে না। কিন্তু এখন অল্প অল্প বুঝছে। যত বুঝছে ততই মনে হচ্ছে বাগানে কি গাছ লাগালে মাসির কষ্ট হবে না। সুজন ভেবে পায় না।

একদিন এসে বলল, মাসি একটা নিমগাছ লাগাবে? আমাদের গ্রামে একটা নিমগাছ ছিল। সেই গাছের তিতা পাতা লোকে নিয়ে যেত। রান্না করে খেত। দাঁত মাজত ওই ডাল দিয়ে। পাপ কি তিতা হয়?

মাসি রাজি হল। নিমগাছ লাগানো হল। মাসি খুশি হল কিনা সুজন বুঝল না। তবে আর সে গাছ কাটা হল না।

বছর গেল। মাসি নেই। ভল্লা জেলে। বাড়িটা বারোভূতে লুটে নিয়েছে। সুজন রোজ এসে বুড়ো শরীরে নিমগাছের নীচে বসে আর বলে, ঈশ্বরের শ্বশুর মরেনি মাসি। ফাঁকি দিয়েছে আমাদের। আবার আমার সব নিয়েছে।

নিমগাছে হাওয়া লাগে। ঝরঝর করে আওয়াজ হয়। সুজন ভাবে ময়না হাসছে। ময়নাও মারা গেছে, সে খবর কি করে সুজনের কাছে এসেছে। সুজনও হেসে ওঠে… বলে, নাম গাছ থেকে…. এক্ষুনি তোর বাবা চলে আসবে!