সৌরভ ভট্টাচার্য
5 May 2020
গত বছর বেড়াতে গিয়েছিলাম সান্তালেখোলা। উত্তরবঙ্গের ছোট্টো একটা গ্রাম। এমন কিছু উঁচুতেও নয়। যারা উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গেছেন তারাই একটা ফুল ঝোপেঝাড়ে, পাহাড়ের কোলে, কারোর বাগানে ফুটে থাকতে দেখেছেন, ওরা ওখানে ফুলটাকে বলে -- নীলকমল।
আমরা এক বৃদ্ধার হোটেলে প্রতিদিন খেতে যেতাম। তাঁর আন্তরিকতা, আপ্যায়নের উষ্ণতা, এমনকি মাঝেমাঝে আদুরে শাসনে মাত্র দু'দিনের আত্মীয়তা গড়ে উঠল। ফেরার সময় তার বাগানে ফুটে থাকা নীলকমলে চোখ আর মন গেল আটকে। মন বলল, “বাড়ি নিয়ে যাব”। বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ ফুলের গাছ কি আমাদের ওখানে বাঁচবে? বৃদ্ধা হেসে বললেন, দেখতে পারো চেষ্টা করে। তারপর খুব যত্ন করে গাছটার একটা চারা ভিজে মাটিতে আটকে, প্লাস্টিকে বেঁধে সাথে দিয়ে দিলেন। তারপর কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে শিয়ালদহ, সেখান থেকে সকালের কল্যাণী লোকালে চড়ে হালিশহরে আমাদের বাড়ি। যথেষ্ট সাবধানে সে চারা এসে পৌঁছালো, মাটি পেল, টব পেল।
কিন্তু যত দিন এগোতে লাগল তত হতাশ হলাম। গাছটা বড় হল, কিন্তু ফুল ফুটল না। কুঁড়িই ধরল না, তো ফুল। ভেবেছিলাম ঠাণ্ডার দেশের গাছ, হয় তো বা এই ঠাণ্ডায় ফুল ফুটবে, সবাই দেখে বেশ তাজ্জব হবে, বলবে, এ গাছ তো আমাদের এখানে নেই, কোত্থেকে আনলে? আমি বলব, সেইইই পাহাড় থেকে, যতটা না সে পাহাড় উঁচু, তার থেকে উঁচুতে উঠবে আমার স্বর, যতটা না সে পথ মসৃণ, আমার হাবেভাবে সে হবে অনেক দুর্গম, আর যতটা না সে গাছটা আনাতে শ্রম হয়েছে, আমি বোঝাব তার চাইতে আরো অনেক বেশি শ্রম, যত্ন, খেয়াল রাখতে হয়েছে। কিন্তু কিচ্ছু হল না। গাছটার কথা ক্রমে ভুলে গেলাম। এত এত নামীদামী দেশী-বিদেশী গাছের মধ্যে তার অস্তিত্ব চাপাই পড়ে গেল।
হঠাৎ কয়েকদিন হল, বাগানে দেখি টবের মধ্যে এমন একটা ফুল ফুটে আছে, যা আমি চিনি না। কাছে গিয়ে বিস্ময়ের অবধি রইল না, আরে! এ তো সেই পাহাড়ি ফুল? হল অবশেষে? হল। যদিও তার সে রূপ নয়, এখানে সে নীল নয়, কিঞ্চিৎ গোলাপী, তবু ফুটেছে তো? তবু বেঁচে তো গেল! হেরে তো গেল না!
এই কথাটাই মনের মধ্যে বড় হয়ে এল। সে বেঁচে গেল। আমার এতবড় স্পর্ধাকে সে জিতে নিল নিজের প্রাণের প্রবল শক্তিতে। যেদিন সে এসেছিল সেদিন আমার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সংকট ছিল না। আজ আছে। আজ আমি গৃহবন্দী। আজ পৃথিবী জুড়ে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। আজ আমারই বাগানে এসে সে ফুলগাছ আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে হেমিংওয়ের সেই বিখ্যাত লাইন, অ্যা ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়েড বাট নট ডিফিটেড। পরাজয় কোনোদিনই স্বীকার করেনি মানবসভ্যতার যাত্রা, আজও হবে না। লড়াই হবে, হয় তো বা ধ্বংসও হবে অনেক প্রাণ, কিন্তু পরাজিত হবে না।
পরাজিত হবে না বলেই সে নিজেকে বদলায়। নতুন পথের সন্ধান করে। “যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন” – এ সূত্র থেকে চ্যুত হলে নিজেরাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, সংসারে যা কিছু যেমন, তেমনই থেকে যায়। রুমি বলছেন, তুমি বলছ সব কিছু নাকি গোল গোল ঘুরছে তোমায় কেন্দ্র করে; ওহে মানুষ! তুমি নিজেকে কেন্দ্র করে এমন ঘোরা ঘুরেছ যে তোমার কাছে বিশ্বসংসার ঘূর্ণায়মান বোধ হচ্ছে, একটু বসো স্থির হয়ে, দেখবে যা যেমন তেমনই আছে। এ স্থির সিদ্ধান্ত।
যদি তাল রেখে চলতে না পারি? তবে ছন্দপতন হবে শুধু আমারই জীবনে। আজ যে কঠিন সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি তা অভূতপূর্ব -- এ সত্য, কিন্তু ঘরে দোর দিয়ে এ সংকট কাটবে না। সব জল কবে চলে যাবে তবে নদী পার হব, এ বাতুলতার কথা। কদ্দিন তবে? এর কোনো আশু উত্তর আমাদের কাছে নেই। আপাতত জানা নেই।
আর একটা কথা বলে এ প্রসঙ্গের ইতি টানি। আজ ফেসবুকের দৌলতে নানা মানুষের অন্দরমহল অবধি আমাদের যাতায়াত। তা ভালো কি মন্দ সে বিচার অর্থহীন। যা বলতে চাই তা হল আমাদের বাড়ির অন্দরমহল কোনো প্রতিযোগীতার ক্ষেত্র নয়, কোনো সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত বিশ্বমঞ্চ নয়। মানুষ তার বাধ্যতামূলক এই বিচ্ছিন্ন জীবনযাত্রায় যা করে তাকে অকারণে বিচার না করে তাকে যেন অ্যাপ্রিসিয়েট করতে শিখি। আমাদের সমাজে অ্যাপ্রিসিশেয়ান কম। তীর্যক মন্তব্য, ব্যাঙ্গোক্তি ইত্যাদির অভাব নেই। কিন্তু তাতে আখেরে মনের বিকাশ ঘটে কি? আমার তো মনে হয় না। আমার পাহাড়ের অসামান্য নৈসর্গিক শোভা ভালো লাগে, কিন্তু তার চাইতেও ভালো লাগে পুরীর সমুদ্রতট, কারণ সেখানে আমি আমার পাড়ার সব চাইতে ছোটো মুদির দোকানের মানুষটাকে একদিন বসে থাকতে দেখেছি সপরিবারে, আনন্দে। আমার হাওড়া রেল স্টেশানে মন উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে সারা ভারতের, সমস্ত স্তরের মানুষের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে, যা দমদম এয়ারপোর্টে পাই না। যেখানে অনেক মানুষের সহজ যাতায়াত সেখানে যে আনন্দের সন্ধান পাই, অন্যত্র কই? সেখানে হয় তো ভোগের সামগ্রীর অভাব নেই, কিন্তু মনের ভিতর সেই মহাপ্রাণী ক্ষুধার্ত থেকে যায়। কি একটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই কোথায় কত মানুষ মদের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়েছে তার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করতেও আমার বাধে। একবার বিবেকানন্দ মদ্যপানের বিরুদ্ধে কিছু বলেছিলেন। তাঁর বাবা তখন তাঁকে ভর্ৎসনা করে বলেন, মানুষ কত দুঃখকে ভোলার জন্যে ওগুলো খায়, মানুষের জীবন কত সংঘাত আর জটিলতাপূর্ণ বড় হলে বুঝবে। এ কথা স্বামীজিই পরে বলেছিলেন, এবং স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বাবার সেই উক্তিকে। তাই বলে নিশ্চয় মদের দোকান খোলেননি এ বলাই বাহুল্য। কথাটা হচ্ছে আরেকটু কম জাজমেন্টাল হওয়া। আরেকটু চিত্তের প্রসার ঘটানো। তার মূল আরো বেশি করে অ্যাপ্রিশিয়েশান করা। এটা যুক্তির কথা নয়, অভ্যাসের কথা। তখন ভালোটাই চোখে পড়া অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়।
এ কথা বলা এইজন্যে যে মানুষ এমন দীর্ঘদিন এমন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে থাকতে অনেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তার মধ্যে আমরা নাই বা আমাদের নানারকম নৈতিক, শৈল্পিক, রাজনৈতিক মানদণ্ড হাতে সহজ স্বতঃস্ফূর্ততাকে আরো জটিল করে তুলি! সুক্ষ্মবিচার যদি করতেই হয় না হয় নিজেরই করি।
আজ যখন আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্য গভীর সংকটে, আমরা যেন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যটিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করি নিজেকে আর আমার চারপাশের খেয়াল রেখে।