তখন অনেক রাত। কোণের প্রদীপটাও অন্ধকারের বুকে একা রেখে যাবে মনে হচ্ছে। বিশ্বাসঘাতকতা করবে - ওর আলো দেওয়ার কথা ছিল। অন্ধকারের জাল কেটে একটু বসার জায়গা বানিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। নিভে গেল। ঘন অন্ধকার চারদিকে। একটা পর্দা উড়ছে চেতনা আর অবচেতনার মাঝখানে। অন্ধকারে অবচেতনা দরজার তলা দিয়ে বৃষ্টির জলের মত গড়িয়ে চেতনার ঘরে ঢোকে। ভিজিয়ে দেয় চেতনার পাতানো সংসার। যারা দরজার ওপাশে হাত নেড়ে মিলিয়ে গিয়েছিল, তারা একে একে এসে ভিড় করে দাঁড়ায় খাটের কোণা ছুঁয়ে, কেউ কেউ মাথা নীচু করে থাকে, যেন মনের এই একলা বিচারালয়ে তার পক্ষের কোনো উকিলকে সে আনতে পারেনি, সব সাক্ষীরাও বিপরীতে।
হঠাৎ করে একটা দমকা হাওয়ায় সব মিলিয়ে যায়। সব সব সব। মনের ভিতরের আদালত সরে গিয়ে আসে ঘূর্ণীঝড়ের মত কান্না। রাগ, ক্ষোভ, অপমান সারা চেতনা জুড়ে ঘায়ের মত দগদগে। টাটকা। মুখের ভিতর জিভ সরালে তিতো তিতো স্বাদ। ঘেন্নার পাঁক তুলছে মন, অথচ মুখে কাপড়ও বাঁধা নেই।
এও থেমে যায়। মানুষটা অন্ধকারে কুঁকড়ে শুয়ে। ওর মনের ভিতর এখন ভাতের হাঁড়ির ফুটন্ত অবস্থা। নিজেই নিজেকে শতচ্ছিন্ন করে নিজের প্রতিটা টুকরোর প্রতিটা রং আলাদা আলাদা করে দেখতে চাইছে। মিলছে না। যা ভেবেছিল কিচ্ছু মিলছে না। দেওয়ালে মাথা কুটে মরা ছাড়া যেন রাস্তা রইল না আর। জীবনে সব চাইতে কঠিন অবস্থা - নিজেকে নিজেই না বুঝতে পারা। পাগলের মত মাথার ভিতর কম্পাস ঘোরাচ্ছে। উত্তর দিকে এসে কাঁটা থামছে না। উত্তরদিকও কি মিথ্যা তবে?
তখন ভোর হবো হবো... মানুষটা বুঝল কিছু একটা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। তার শতচ্ছিন্ন সত্তাগুলো তার পাশে শুয়ে। প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা রং। সে বুঝেছে, মানুষ একরঙা না। অনেক মানুষের অনেক রঙের ছোপ দিয়ে গড়া হয় এক একটা মানুষ। কেউ কেউ রঙ করবে বলে তুলি নিয়ে আসে, বড় একটা ক্যানভাস চায়... অথচ পুরো রঙ না করেই চলে যায়। ফাঁকা ক্যানভাসে অসম্পূর্ণ রঙ... অনালোকিত গুহার মত অন্ধকারে গর্জায় অবচেতনা... কাঁদে... ছটফট করে... ভুলে যায়... মনের গভীরে চাপা দিতে চায়, আরো গভীরে গর্ত খোঁড়ে। তৈরী হয় অবচেতনের অচেতন। তবু ওরা জাগে। এরকম কোনো কোনো রাতেই জাগে। আজ যেমন জেগেছে।
মানুষটা ভোরের আলো বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে তার নিজের বাইরে আরেকটা দেওয়াল আছে, যে দেওয়ালে রঙ করার দায়িত্ব তার। সেই দেওয়াল দিয়ে বানানো হয় ঘর। যে ঘরের মধ্যে পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হলে, নিতে আসে বিশ্রাম। সে দেওয়ালের রঙ নীল। তার রঙ ওই আকাশে, ওই গহন সমুদ্রে, আর কারো কারো চোখের মণিতে।
মানুষটা হাত বাড়ালো। উপরের দিকে। নিজেকে ছাপিয়ে নিজের থেকে বড় নিজের সন্ধান যেন সে পেল, যখন সব ভাঙল। সে বুঝল সব ভাঙলেও ভাঙতে পারে, শেষ হতে পারে না। শেষ বলে কিছু হয় না। নিঃশেষ হওয়ার ভয়টাই শুধু সত্যি, নিঃস্ব হওয়াটা নয়।
(Samiran দার ছবিতে গল্প বলেন। ভাবান। এই ছবিটা একটা গল্পের সূত্র দিল। মনের গল্প। নিজের সাথে নিজের গল্প। যে কথাগুলো এলো তাদের সাজালাম। প্রণাম জানবেন দাদা।)