কাজের দিদি সাতসক্কালে এসে উপস্থিত। বললাম, এত সকাল সকাল? সে বলল, আজ নীলের উপোস যে। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে গঙ্গায় যাব স্নানে।
খানিক পর রান্নার দিদি। সেও তাড়াতাড়ি। কারণ এক, নীলের উপোস। মায়ের, সন্তানের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা।
ছোটবেলার দিনগুলো চরকীর মত ঘুরতে ঘুরতে সামনে এসে দাঁড়াল। মা দাঁড়ালেন এসে লাল পাড় সাদা শাড়ী গায়ে দিয়ে। ছোটবেলার মা। বেশ মজা হত। এই দিন বকা চলবে না। যত বাঁদরামি করো, বকা খাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ঠাকুমা সাবু মেখে রাখতেন বড়মা আর মায়ের জন্য। মিষ্টি সাবু আর নোনতা সাবু মাখা, তার সাথে বেলের সরবত। অন্যদিন হলে ওগুলো খেতে দিলে হয়তো ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধাতাম। কিন্তু সেই বিশেষ দিনটায় ওগুলোই অমৃতর মত লাগত। মা, বড়মা, ঠাকুমার লাগামছাড়া প্রশ্রয় (তৃতীয় জনের অবশ্য নীলের বিশেষ দিন লাগত না প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য), একটু বেশি বেশি গুরুত্ব পাওয়া, আদর পাওয়া। সে এক বিশেষ দিন!
তারপর বড় যখন হলাম, মাকে উপোস করতে বারণ করতে শুরু করলাম। বোঝালাম, দেখো উপোস মানে উপবাস। না খাওয়াকে উপোস বলে না, ঈশ্বরের নিকটে বাস করবার সঙ্কল্পকে উপবাস বলে। কত কত মহাপুরুষদের উক্তি শোনাতাম অনশনের বিরুদ্ধে। কাজ হত না।
মায়ের হৃদিশাস্ত্রর কাছে মহাপুরুষগণ তুচ্ছ! কে মানে? কেউ মানে না। অগত্যা কাজও হত না। মা তর্ক করতেন না। হাসতেন। যুক্তিহীন, আপোসহীন স্নেহের যে কি বালাই!
শিব মন্দিরে জল ঢেলে যখন বাড়িতে আসতেন, মায়ের ফর্সা মুখটা রোদে লেগে তামাটে হয়ে থাকত। চোখের দৃষ্টিতে কি অপরিসীম স্নেহের তৃপ্তি। তখন ঠাকুমা নেই। সাবু মাখতাম আমি, সরবত বানাবার দায়িত্বও নিতাম আমি। কোনোদিন নাকি সেটা খারাপ হত না। ভীষণ সুন্দর মাখা হত প্রতিবারই নাকি!
আজ মা নেই। দু'বছর আগের নীলের দিনটার কথা মনে পড়ল। প্রথম মা ছাড়া নীলের দিন। পাড়ার সব কাকিমা, জেঠিমারা সেইরকম শাড়ি পড়ে মন্দিরে যাচ্ছেন, সেই স্নেহের আবীর চারদিকে, আমার যেন আবীর কেনা হয়নি সেবার। কান্নাটা মাছির মত বারবার নাকে উপর, গলার উপর এসে বসছে, আমি প্রাণপণ তাড়াবার চেষ্টায় আছি। একটা লেখা লিখেছিলাম -
আগুন অভিমান
--------------------------
আমার তবু একা একা ভাত বাড়তে কান্না লাগে
তুমি বলতে, কেউ খেলে পাশে বসতে হয় তার
তুমি ভুলে গেলে
টিভির অপরিচিত লোকেদের সাথে বসি খেতে
দু’ঢোক কান্না গিলে, একদলা ভাত নামে গলা দিয়ে
তুমি চলে গেলে
মাঝে মাঝে ভাবি, চিতার আগুন কি কৃপণ হত
আমি তোমার সাথে, তোমার পাশে শুলে?
তবে এটাই শেষ কথা না। আজ জ্বর হলে কোনো সুহৃদের হাত যখন কপাল ছোঁয়, রান্নার দিদির অনুপস্থিতিতে যখন কোনো সুহৃদ, রান্নাঘরে স্বল্প অভিজ্ঞতাতেই বীরবিক্রমে প্রবেশ করে, এপাশ ওপাশ চোখের শাসন যখন অকৃত্রিম স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে চায়, তখন মনে হয় বহুযুগ আগে কোনো আত্মদ্রষ্টা ঋষির বাণী -
যা দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তসৈঃ নমস্তসৈঃ নমস্তসৈঃ নমো নমঃ
এ না হলে থাকাটা বাঁচা হত না, শুধুই থাকা হত।