Skip to main content
 
        রামশংকরের সকালবেলায় উঠেই আজ প্রথম নিজেকে ভালো লাগল। এর আগেও অনেকে তাকে বলেছে। অনুভব করতে পারেননি। আজ একটা শালিখ পাখির মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মনে হল তিনি আসলে একজন ভালোমানুষ। তারপর রামশংকরবাবু অনেকক্ষণ বিছানা থেকে নামলেন না। খাটের বাঁদিকে নীচে দুপাটি চটি রাখা। হাওয়াই চটি। নীলরঙের। তাতে নতুন ফিতে পাল্টেছেন গতকাল শুতে আসার আগে। তখনও নিজেকে এত ভালোমানুষ মনে হয়নি। এখন কেন হচ্ছে? শালিখটা উড়ে গেছে। কটা বাজে?
        রামশংকর বাসে বসে আছেন। বাস কলকাতার শিরা-উপশিরা দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। মেঘলা আকাশ। রামশংকর আফটার সেভের গন্ধ পাচ্ছেন নিজের গাল থেকে। গলার দিকটা একটু কেটেছে, জ্বলছে। রামশংকর হাত দিয়ে দেখলেন। সামনের অগাস্টে রামশংকর তেষট্টিতে পড়বেন। একটা মাড়োয়ারির দোকানে অ্যাকাউন্ট্যান্ট রামশংকর। সেই বত্রিশ বছর থেকে। জুটমিলটা বন্ধ হওয়ার পর। রমা, মানে ওনার স্ত্রী গলায় দড়ি দেন। মাথায় গোলমাল ছিল। পায়ের চটিটায় একটা আরশোলা উঠেছে। আজকাল বাসে প্রচুর আরশোলা। ওরা কোথাও যায় না। বাসে করে সারা কলকাতা ঘোরে। রামশংকর পায়ের একটা ঝাঁকুনি দিলেন। পাশের লোকটা ঝিমোচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে একবার চোখ খুলেই বন্ধ করে দিল। রামশংকর অস্ফুটে বললেন, উল্লু!
        রাত আটটা। পাড়ার গলিতে বাড়িগুলোর জানলার আলো। স্ট্রীট লাইট জ্বলে না। ভেঙে দেয়। এখানে ওখানে জুয়ার আড্ডা। রামশংকর রাস্তার একটা ধারে দাঁড়িয়ে হিসি করেন। পাড়ার কুকুর, মোলু পায়ের কাছে এসে পা শুঁকছে। রামশংকর বাড়ির দরজার তালাটা খুলে ঢুকে ঘরের আলো জ্বালালেন। ডাইনিং টেবিলে রাখা বিস্কুটের কৌটো থেকে একটা বিস্কুট এনে মোলুকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়ে দিলেন। স্নান করে, একটা নীল চেকচেক লুঙ্গী পরে টিভিটা অন করলেন।
        রাতের খাওয়া শেষ। ভাত আর ডালসিদ্ধ, এই বছর দশেকের রাতের খাবার। মশারি টাঙালেন। গুনগুন করে গান গাইছেন। শ্যামাসংগীত। ডাইনিং রুমে এসে বোতল থেকে এক ঢোক জল খেলেন। হাওয়াই চটিটার নতুন ফিতে, একটু টাইট। পরে লুজ হয়ে যাবে। আজও একটা দড়ি আনলেন। ফাঁস করে পাখার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। রমাকে দেখছেন। রমাকে সকালবেলায় ঝুমা, কাজের লোক দেখেছিল। তিনি দেশের বাড়ি কৃষ্ণনগর গিয়েছিলেন। জমিজমা নিয়ে একটা ঝামেলার রফা করতে। টুলটা আনলেন। পাখার সাথে দড়িটা বেঁধে ফাঁসটা চেক করে দেখলেন। টানটান আছে। টুলের উপর দাঁড়িয়ে মাথাটা ফাঁসে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। রোজ দাঁড়িয়ে থাকেন। রমাকে ছুঁয়ে থাকেন। শেষ সময়টা থাকতে পারেননি ওর সাথে।
        তবে আজ ভার ভার লাগছে না। বুকটা হাল্কা। তিনি অপরাধী নন। রমার যাওয়ারই ছিল। বগল থেকে পাওডারের গন্ধটা আসছে। জুঁইয়ের গন্ধ।
 
        সেদিন রাতেই কলকাতায় সেই বড় ভূমিকম্পটা হয়েছিল। রিখটার স্কেলে সাড়ে আট প্রায়। টুলটা হড়কে গিয়েছিল পা থেকে। তিনি চাননি। দুদিন পর পাড়ার লোক দরজা ভেঙে ঢোকে।