সৌরভ ভট্টাচার্য
11 May 2019
গাড়ি ছাড়ল ন'টা নাগাদ। হালিসহর থেকে। করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুপুরে হাওড়া থেকে। মা-কে নিয়ে ভেলোর যাচ্ছি চেক-আপে। নভেম্বরের মাঝামাঝি। গরম রয়েছে কিছুটা, খুব নয়।
গাড়ি কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে শেষে সোদপুর ঢুকছে। মা বললেন তাঁর একটা চটি কিনবার আছে। দীর্ঘদিন শয্যাবন্দী, হাওয়াই চটি ছাড়া আর কোনো চটি দরকার পড়ে না। আজ অনেকদিন পর বেরোলেন। হোক চেক-আপের জন্য যাওয়া, তবু ভালো একটা চটি কিনবেন। যেটা পরে বেরিয়েছেন সেটা দীর্ঘদিন না পরায় রঙটা উঠে কেমন বিশ্রী দেখাচ্ছে যে। ঠিক হল সোদপুর বাজারে নেমে চটি কিনবেন। আমি ভাবলাম চেন্নাই থেকে কিনে নিলেই হত, কিম্বা ভেলোরে গিয়েই। কারণ, প্রথমত মায়ের শরীর ভালো নয়, তাতে এতটা পথ, যতই এসি কোচ হোক, ধকল তো থাকেই। দ্বিতীয়ত, মনে হল যদি ট্রেন মিস হয়ে যায় কোনো কারণে রাস্তায় কোথাও ফেঁসে গেলে? বাবা স্থিরচিত্তে বললেন, বেশ আমরা চটি কিনেই যাব।
সোদপুরে রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করানো হল। বাবা মা'কে ধরে ধরে নিয়ে নামলেন। আমি আর বোন গাড়িতে বসে জিনিস পাহারায় থাকলাম। খানিক বাদে বোন বলল, তুই বোস আমি আসছি।
আমি গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে দিলাম। ব্যস্ত রাস্তা। ওই ফুটে মা আমার দিকে পিঠ করে একটা বেঞ্চিতে বসে। চুলটা পিঠের উপর পড়ে। পিঠে রোদ পড়ছে। বাবা খুব একাগ্র চিত্তে দোকানির সাথে কথা বলছেন। বোন ঝুঁকে বসে শাড়িটা একটু উঁচু করে দিয়ে চটি পরতে সাহায্য করছে। রাস্তায় হাজার একটা মানুষের যাতায়াত। কেউ কাউকে চিনি না। কেউ জানেও না একজন ভীষণ অসুস্থ মানুষ নিজের একটা প্রিয় শখকে জলাঞ্জলি না দিয়ে সম্মানের সাথে তা পূরণ করছেন। তিনি নিজেও জানেন না কদ্দিন এই চটি পরার সুযোগ পাবেন। আমি-বাবা-বোন কেউ জানি না।
মা ফিরে আসছেন। পুরোনো চটিটা প্লাস্টিকে জড়ানো। পায়ে নতুন চটি। ঘিয়ে ঘিয়ে রঙের। রাস্তার ওফুটে দাঁড়িয়ে তিনজনে। মাঝে মা। দুটো হাত দু'জনে দু'দিকে ধরে বোন আর বাবা। আমি ঘিয়ে চটির সামনে লাল নেলপালিশ পরা বুড়ো আঙুলটা দেখতে পাচ্ছি। মা রাস্তাটা পেরিয়ে আসবেন। গাড়িতে উঠবেন। হেসে বলবেন, "দ্যাখ কি সুন্দর চটিটা, দেখেছিস?" মায়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকবে। আমি রুমাল বার করে সিঁদুরের বিন্দুটা সামলিয়ে মুখটা মোছাতে মোছাতে বলব, "কি যে করো... এত ধকল নিলে... আগে জানলে আমি কাঁচরাপাড়া গিয়ে কিনে আনতাম।..."
গাড়ি চলল। দোকান ছেড়ে গেল। মা চোখ বন্ধ করে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে। মুখটা ক্লান্তিতে তৃপ্তিতে বিবর্ণ উজ্জ্বল। আমি জানলার কাঁচ দিয়ে বাইরের কলকাতা দেখছি। আমি ডাক্তার বুঝি, ওষুধ বুঝি, প্রেসার-সুগার বুঝি, বেডপ্যান-ডেটল ইত্যাদি বুঝি। নতুন চটির কথা বুঝি না, বাবা বোঝেন।
আজ হঠাৎ কেন লিখলাম? একই রকম চটি পরা একজন মানুষ আজ আমার বাড়িতে এলেন। সে চটিটা ছেঁড়া। সে মানুষটার এক ছেলে আছে, আজ তাকে খুব বলতে ইচ্ছা করল, "ভাই মাকে একটা নতুন চটি কিনে দিও। কেন এই চটি পরে তোমার মা রোজ রোজ কাজে বেরোবেন বলো?"
মায়ের সে চটিটা আমার কাছে যত্নে রাখা আছে। পা-দুটো পড়ে না বলে ক্ষয়ে যায় না, এই যা।