সৌরভ ভট্টাচার্য
24 May 2019
নটুবাবুর সমস্যা হল তিনি হিন্দি যতটা ভালো বোঝেন, ততটা বলতে পারেন না। বাংলা বাদে বাকি ভারত এতদিন বেড়াবার জায়গা ছিল, জানার বা অনুভবের জায়গা ছিল না। নটুবাবু চর্যাপদ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিছু পড়েছেন, কিছু শুনেছেন, কিছু জেনেছেন। ইংরাজি, ফরাসী, রাশিয়ান ইত্যাদি নানা ভাষায় নানা লেখকের নাম শুনেছেন, কিছু পড়েছেন, কিছু জেনেছেন। আসলে তিনি এতটা উঁচুতে দাঁড়িয়ে থাকতেন যে পশ্চিমদিক তাকালে ভারতের অন্যান্য রাজ্য ছাপিয়ে, মধ্য এশিয়া ছাপিয়ে এক্কেবারে ইউরোপে স্বগোত্রীয় মানুষের মুখ দেখতে পেতেন।
সব জিনিসের ক্ষয় হয়। তিনি যে পাদানির উপর দাঁড়িয়ে থাকতেন সেই পাদানিটিও কিছুটা কালের নিয়মে আর কিছুটা নিজের অবহেলায় ক্ষইতে ক্ষইতে যে কখন ভূমিতে এসে ঠেকেছে নটুবাবু খেয়াল করেননি। তার নিজের হাতে গড়া একটা মিউজিয়াম ছিল। সেই মিউজিয়ামে রামমোহন থেকে শুরু করে সত্যজিৎ অবধি প্রমাণ সাইজের মূর্তি ছিল। প্রতিদিন স্তব গাইতেন নটু বাবু। সেই মিউজিয়ামের উপর তলাতে তো শুধু একটাই মূর্তি ছিল - রবীন্দ্রনাথের। ওর উপরে ছাদ। তার উপরে আকাশ। সেই মূর্তিগুলোর উপর ধুলোর আস্তরণ ছিল পুরু। নটুবাবুর কায়িক শ্রমের অভ্যাস ছিল না। তা এত উঁচু মিউজিয়ামে উঠে স্তব গাইবার সময় এত হাঁপাতেন যে সেই হাঁপানির হাওয়াতে মূর্তির গায়ের ধুলোবালিগুলো ঢুকত নাকে-চোখে-মুখে। সেই ধুলো রোজ লেগে তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছিল। নিজেকে ছাড়া কাউকেই স্পষ্ট চোখে পড়ত না। এত বড় করে নিজেকে চোখে পড়ত যে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পথটাও পর্যন্ত ঢাকা পড়ে যেত। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তিনি মনের সুখে ছিলেন। লোকে বলত মূর্খের স্বর্গ।
হঠাৎ করে সে সুখ ভাঙল। হুড়মুড় করে গোটা উত্তর ভারত প্রায় তার সখের সাজানো সঙ্গে সংসারে ঢুকে পড়ল। ঘরদোর পাঁচিল দরজা জানলা এত আলগা হয়েছিল খেয়ালই করেনি গো মানুষটা? যে মানুষগুলোর সংস্কৃতি নেই, নোবেল নেই, অস্কার নেই, ভিয়েতনাম-চীন-রাশিয়ার সাথে হৃদয়ের যোগ নেই, নিউরনের সাথে ফ্রান্স কিম্বা জার্মানির দার্শনিকদের ভাবের যোগ নেই, সেই চিন্তাশক্তিহীন তুলসীদাস-সুরদাস-কবীর, প্রেমচাঁদের মত কতকগুলো গ্রাম্যসাহিত্যের আস্ফালনে যারপরনাই বিস্মিত হয়ে, কেঁদেকঁকিয়ে মিউজিয়ামটার দিকে তাকালেন। ওমা!!! সেটা কই? নেই যে! তিনি এতজোরে চীৎকার করলেন যে হৃৎপিণ্ড দুটো বিট হারিয়ে ফেলল। তিনি বললেন, আমার পাদানিটা কই? হায় হায়, সে তো কবে মাটির নীচে দশহাত দেবে বসে আছে গো!
নটুবাবু জানতেন না আসলে অনেকদিন হল কিছুই ছিল না। শূন্যের আবর্তে, ধুলোর ধাঁধায় এক দারুণ গোলকধাঁধা সৃষ্টি হয়েছিল। আজ সব মিশতে চাইছে কালের চাকার তলায়। যদি কিছু খাঁটি বীজ থাকে তবে নতুন গাছ জন্মাবে। নইলে ক্রমে বৈশিষ্টহীন গোত্রহীন হয়ে সংখ্যাগুরুদের গুরুত্বেই নিজের অস্তিত্বের বীজ বুনতে হবে। ভরের নিত্যতা সূত্র অনুযায়ী শূন্যে লীন হবেন না নটুবাবু, কিন্তু নিজেকে আর চিনতে পারবেন না হয়ত, যদি না আবার আত্মমন্থন শুরু হয়। সে মন্থন প্রাচীন ইতিহাস ঘেঁটে নয়, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, এই সময়ের মানদণ্ডে।