যে মানুষের ভিতর থেকে বিশ্বাস মরে গেছে, কিন্তু তবু বিশ্বাসের ভান নিয়ে বেঁচে আছে, সে নষ্ট মানুষ। এমন নষ্ট মানুষ সংসারে অনেক দেখা যায়। সাধু, সংসারী বলে কিছু হয় না, খাঁটি মানুষ আর নষ্ট মানুষ।
পারমিতা পাশ থেকে উঠে যাওয়ার পর একাকীত্ব বোধটা চলে গেল অশোকের। লাভাতে এসে এই সরকারি কটেজগুলো তার ভীষণ প্রিয়। প্রত্যেক বছর পারমিতা আর সে আসে। সামনের এই বসার জায়গাটা যেন স্বর্গের সুখ। সামনে পাহাড়ের পর পাহাড়। আলো, ছায়া, মেঘ, রোদ খেলছে। পাখির ডাক। সব মিলিয়ে কি যে সুখ! কিন্তু একা বসলেই সুখ। পারমিতা পাশে বসলে একাকীত্ব। কিছু মানুষের সঙ্গ একা করে দেয়। দু'জন নষ্ট মানুষ দু'জনকে আরো একা করে দেয়। তারা দু'জনেই নষ্ট। তবু কেন যে আছে একসঙ্গে, কিসের ভয়ে?
পারমিতা হাইস্কুলে পড়ায়। অশোক প্রাইভেটে বেশ বড়সড় কাজ করে। বাইরে থাকে। বছরে মাসখানেকের জন্য আসে।
অশোক বুঝতে পারছে বাইরের জগতটা ভিতরে আগের মত ঢোকে না। বাইরের আনন্দের আসার পথ বন্ধ। ভিতরেও আনন্দ নেই। অপেক্ষা আছে। দমচাপা বোধ আছে। তারা দু'জনেই শান্তিনিকেতনে পড়েছে। সেখানেই আলাপ, প্রেম। একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত। ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া। একে অন্যকে দোষারোপ। একদিন তা-ও থেমে যাওয়া। এখন শুধু নিয়মমাফিক ক'টা কথা। অভ্যাস। সমস্যাটা আসলে দু'জনের দু'জনকে নিয়ে নয়, সমস্যাটা হল দু'জনেরই জীবন নিয়ে প্রাথমিক মূল্যবোধগুলো বদলে গেছে। দু'জনেই সেটা স্বীকার করতে লজ্জা পায়। বিবেকের সামনে একে অন্যকে অতীতের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে। যেন দু'জনেই এক আছে। আসলে নেই। দু'জনেই জানে। মানে না। বিশ্বাসের ভান নিয়ে বেঁচে আছে। নিজেদের মিথ্যা বলে বেঁচে আছে।
=======
অশোক উঠে রুমে গেল। পারমিতা শুয়ে আছে। আলোটা জ্বালতেই বলল, জ্বেলো না… মাথাটা ধরেছে।
অশোক ল্যাপটপটা অন্ করে পাশে বসল। মোটা বিছানাটা অল্প দেবে গেল। নড়ল।
পারমিতা, উফ্, বলে পাশ ফিরে শুলো। ওদিকে মুখ।
অশোক বই পড়বে। বুদ্ধদেব গুহ। মাধুকরী। পিডিএফ। আজকাল প্রচুর বাংলা পিডিএফ পাওয়া যায়। বাইরে থেকেও বাংলা সাহিত্যের খোরাক মিলে যায়। আগে বুদ্ধদেব গুহের লেখা ভালো লাগত না। ন্যাকামি লাগত। আজকাল তৃষ্ণার জলের মত লাগে। মাধুকরীর প্রতিটা লাইনে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার জায়গা খুঁজে পায়। সব ভালোবাসা যেন জমে আছে অন্যখানে, অন্য কারোর কাছে, যাকে সে পায়নি, তার কাছে। এও মিথ্যা, জানে। তবু সত্য বলে বিশ্বাস করে। বিশ্বাসের ভান করে। যা মিথ্যা বলে জানা যায়, তাকে বিশ্বাস করা যায় না খাঁটিভাবে। বিশ্বাসের ভান করা যায়। এই যে ধর্মীয় বিশ্বাসের আগুনে আতঙ্কবাদের জন্ম হয়। আসলে তো সেটা ধর্মীয় বিশ্বাস নয়। বিশ্বাসের ভান। হিংসা, দ্বেষের প্রবৃত্তিকে নিয়ে ব্যবসা সেটা। বিশ্বাস তো ভান শুধু।
======
চা খাবে?
ক'টা বাজে?
পাঁচটা… খেলে না তো কিছু….
বমি হয়ে যেত… কফি পাঠাতে বলো…
=======
সন্ধ্যে হল সবে। দু'জনে পাশাপাশি হাঁটছে।
অশোক বলল, চারদিকে মানুষের বিশ্বাস বদলে বদলে যাচ্ছে…. রাজনীতির রঙ দেখো…. কেমন সব হচ্ছে না…. মানুষ ভীষণ কনফিউজড্…. তোমার কি মনে হয়….
পারমিতা বলল, দেখো আমার মনে হয় আর কোনোদিন ক্লাসিক কিছু লেখা হবে না….. ক্লাসিক কোনো সিনেমা হবে না…. মানুষ বুঝে গেছে….
কি?
দাঁড়ালো অশোক। পারমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে। বয়েস হচ্ছে দু'জনের। রাস্তায় দাঁড়ালে তবু সরাসরি চোখের দিকে তাকানো যায়। ব্যস্ততার আড়াল থাকে। কিন্তু ঘরে বড্ড নগ্ন সত্যটা। দুর্বল মিথ্যাটা। ভানটা।
পারমিতা বলল, দেখো, মানুষ আগে মানুষের মধ্যে একটা ডিগনিটিতে বিশ্বাস করত। যেটাকে সে ভাবত ফাণ্ডামেন্টাল। ধর্মীয় আদর্শ বলো, রাজনৈতিক আদর্শ বলো… কোথাও মানুষ একটা মানুষের ফাণ্ডামেন্টাল ডিগনিটিকে রাখত, তাকে যাই বলুক না কেন… এখন মানুষ জানে… আসলে মানুষ ধূর্ত আর বোকা। এখন কোনো ডিগনিটিতে কেউ বিশ্বাস রাখে না। ওসবের ভান করে কাজ চালিয়ে নেয়। কিন্তু সে-ই বা আর কদ্দিন। সব ভেঙে পড়বে। আর ডিগনিটি না থাকলে, বেসিক ভ্যালুগুলো না থাকলে ক্লাসিক সৃষ্টি হয় কিছু?
======
রাত একটা দশ। যৌনতার জন্য বিশ্বাস লাগে না। প্রেম লাগে না। হরমোনের একটা নির্দিষ্ট মাত্রা লাগে শরীরে। সুখ নেই। সুখের স্মৃতির ব্যথা আছে। পাগলামি নেই। পাগলের বুকে আঁচড় আছে। কে আটকে রেখেছে পাগলকে?
অশোক শালটা জড়িয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। বাবা ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল অত্যন্ত স্মোকিং। তবে বিশুকাকা আজও জিন্দা আছে কি করে? রিকশা চালায়। তার ছেলের মুদির দোকান। তাদের আগের পাড়াতেই, শ্যামনগরে।
=======
গাড়িটা নামছে। ঘুর পথে। মাথা ঘোরে। বমি পায় অশোকের। ছেলেবেলা থেকে। মাথার কাছে হাতলটা শক্ত করে ধরে থাকে, গাড়ি ঘুরুক, ঘাড় যেন না ঘোরে। তবে বমি পায় না।
চারদিকে এমন সব অসামান্য দৃশ্য! সব চেনা। তবে আগের মত মনের উপর আনন্দের হাত বুলায় না। সব কেমন উপর দিয়ে চলে যায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে যে সত্য, তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার জীবনের কেন্দ্র।
পারমিতা চোখ বুজে শুয়ে। গরুবাথানের কাছে এসে একবার জিজ্ঞাসা করল, বিশুদাকে গাড়িটা আনতে কল করেছ?
অশোক বলল, হ্যাঁ।
বিশুদাকে কলটা পারমিতার সামনেই করেছিল, হোটেলে খেতে খেতে। পারমিতা তখন মোবাইলে ডুবে। হোয়াটস অ্যাপে। ওর চশমায় রিফ্লেকশান আসছিল। দৃষ্টিতে চুরি জন্ম নিচ্ছে অশোকের। সন্দেহের বেসাতি। নষ্ট মানুষ। দু'জনেই।
=====
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশানে বসে। প্রচণ্ড গরম।
রাতে কি খাবে?
চাউ প্যাক করে নাও
=======
অনেক রাত। উপর নীচ দুটো বার্থে দুটো মোবাইল অন। এসি টু টায়ার।
মেজমাসির মেয়ের বিয়েতে যাবে?
পারমিতা উত্তর না পেয়ে নীচের বার্থে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
অশোক ঘুমাচ্ছে। মোবাইলটা বুকের উপর রাখা। চেঞ্জটা কোথায়, কবে শুরু হল? কি বদলালো? এ এক খেলা। মাঝে মাঝেই উৎসটা খোঁজার চেষ্টা। পাওয়া যাবে কি করে? চোখ কি চোখকে দেখতে পায়?
=====
অশোক ঘুমাচ্ছে। অশোক নয় যেন, অশোকের ভান করে অন্য মানুষ। বুকের উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে ওর ব্যাগে ভরে, পারমিতা পায়ের কাছে বসল। ঘাড়ে ব্যথা করছে। ঘুমন্ত মানুষের সঙ্গ বড় আরামের। স্মৃতিগুলো সবাক। জিভ নির্বাক। মাথা নিজেই নিজের সঙ্গে দাবা খেলায় বসে। কেউ কাউকে চেকমেট করবে না। অশোকের মুখের উপর স্মৃতির আলো ফেলে, ছেড়ে আসা দিনের স্মৃতি হাতড়াচ্ছে পারমিতা। এও এক খেলা।
=====
অশোক পারমিতার গায়ের গন্ধ পাচ্ছে। বুকের সব পাথর সরিয়ে সরিয়ে একটা ক্ষীণ চোরাগোপ্তা নদী খুঁজছে। এক আঁজলা না হোক, আধ আঁজলা জলও কি নেই? সব কি শূন্য?
সারা ট্রেন নষ্ট মানুষ। সারা জগতজুড়ে নষ্ট মানুষ। অশোকের চোখের কোল বেয়ে গরম জল নামত আগে, আজকাল জন্মাবার আগেই শুকিয়ে যায় জল। সবাই কাঁদতে চায়। একদিন মানুষ কাঁদবে। আবার সব ঠিক হবে। কান্নার জলে নতুন বিশ্বাসের বীজ অঙ্কুরিত হবে। কি বিশ্বাস, জানে না অশোক। কেউ-ই জানে না।