Skip to main content

        নীলেশ কয়েকবার কৃষ্ণনাম গেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল এক-দু'মিনিট। কেউ বাইরে এলো না। নীলেশ উঠোনের গেটটা আটকে আরেকবার রাস্তা থেকেই বাড়ির ভিতরের অন্ধকারটায় দৃষ্টি হাতড়ে হাঁটতে শুরু করল। সব বাড়ি যায় না। দরজায় দাঁড়িয়েই বাড়ির ভিতরের অবস্থা বুঝতে পারে নীলেশ। অভ্যাস হয়ে গেছে। ফুটো ছাতাটা মাথার উপর ধরে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করছিল তার ধুতির নীচেটা কাদায় লুটোচ্ছে। তিনটে ধুতি আছে, দুটো ফতুয়া। একটা কুকুর কিছুটা তার সাথে সাথে এসে থেমে গেল। ওর বেশি আর এগোবে না। ওকে চেনে, বহুদিন হল এ পাড়ায় ভিক্ষার জন্য আসছে।

        নীলেশ আগে ধূপকাঠি বিক্রী করত ট্রেনে। বিয়ে করল পঁচিশ বছর বয়সে তার থেকে দু'বছরের বড় একটা মেয়েকে। বিয়ের তিন বছরের মাথায় মিনতি আত্মহত্যা করে। 
        নীলেশ জগদ্দল স্টেশানে এসে বসল। তার কাপড়ের ব্যাগে ঠোঙায় করে মুড়ি আর নারকেলের দুটো অর্ধচন্দ্রাকার টুকরো নিয়েই বেরিয়েছে। আষাঢ় মাস। মেঘলা আকাশ। গুমোট গরম। মদনপুর যাওয়ার ট্রেন এখনও পঞ্চান্ন মিনিট দেরি। একটা বেঞ্চে বসল। ফাঁকা স্টেশান। একটা পনেরো বাজে।

        মিনতিকে প্রথম দেখে ওর বান্ধবীর সাথে ট্রেনেই। কালো রোগা চেহারা। কিন্তু মুখটা এত মমতা মাখা! ওরা কাঁচরাপাড়া থেকে উঠেছিল। নীলেশ তখন থাকত গয়েশপুরে। নীলেশও উঠল কাঁচরাপড়া থেকেই। নীলেশ কল্যাণীতে নামল, ওরা দুই বান্ধবীও কল্যাণীতে নামল। নীলেশ তখন কিছু তেমন একটা করে না। পঁচিশ বছর বয়েস। এক বন্ধুর ক্যাটারিং-এর ব্যবসা, তাতেই মাঝে মাঝে কাজে লেগে যেত। বাড়িতে বাবা-মা আর ছোটো ভাই।
        ওরা দুই বান্ধবী জওহরলাল হাস্পাতালে গেল, সে-ও গেল। পরে জেনেছিল ওরা গিয়েছিল মিনতির ওই বান্ধবীর মাসিকে দেখতে, যার গলব্লাডার অপারেশান হয়েছিল; আর নীলেশ গিয়েছিল কাজ খুঁজতে, একজন বলেছিল হাস্পাতালে দুপুরের খাবার সাপ্লায়ারের কাজ দেবে, নীলেশের সেই ক্যাটারিং করা বন্ধুই পাঠিয়েছিল তাকে। হাস্পাতালেই পরিচয় করল নীলেশ মিনতির সাথে। পরিচয় থেকে প্রেম, তারপর বিয়ে। দেড় বছরের মধ্যে সবটুকু ঘটে গেল। সংসার চালাতে নীলেশ হকারিতে এলো।
        সমস্যার সূত্রপাত শুরু হল মিনতির মা অভয়াকে নিয়ে। অভয়া'র গল্পটা খুব সোজা না। বাংলাদেশ থেকে অভয়া তিন মেয়ে আর বিজনকে নিয়ে এদেশে যখন মাথাগোঁজার একটা জায়গা খুঁজছিল, তখন অভয়ারই এক লতায় পাতায় দাদার বন্ধুর কাকা পরিতোষ পাল, কাঁপাতে জায়গাটা দেয়। বিজনের বাংলাদেশে ছিল কাঠের কাজ, এদেশে এসে পসার জমাতে বেশি সময় লাগল না, কারণ তার হাতের কাজ ছিল অসাধারণ। তার মত পালঙ্ক এই তল্লাটে আগে কাউকে বানাতে দেখেনি কেউ। ফলে হল কি কয়েকমাসের মধ্যেই কলকাতায় একটা বড় দোকানে সে কাজে চলে গেল। বাড়ি আসা কমতে শুরু করল তার। অভয়া একে দেশ হারানো, তায় স্বামীর সাথে দূরত্ব, তিন মেয়ে নিয়ে সংসার, নাজেহাল হতে শুরু করল। বিরক্তি প্রায় চরম সীমায় পৌঁছাল যখন, সে একটা কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করল বেড়ার ঘেরা আর টালির ছাওনি দিয়ে। চুলে জট বানালো। লাল চেলি পরল। মাঝে মাঝেই ভর হতে শুরু করল। এই পাড়ায় সে নতুন, এই ভেক বেশ কাজেই লেগে গেল। শনি-মঙ্গলবার লোকের ভিড় ঠেলা দায় হত। অভয়ার ক্রমশঃ মনে হতে শুরু করল, তার ভরটা সত্যিই। সে নিজের ভরের মোহে নিজে পড়ে সংসারটা পুরো মিনতির ঘাড়ে ঠেলে দিল। তিন মেয়ে বেড়ে উঠতে লাগল। তাদের বিয়ে নিয়ে মাথাব্যথা না বিজনের না অভয়ার। দু'জনে এখন যেন একটা অদৃশ্য যুদ্ধের বিপরীত পক্ষ। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। বিজন বাড়ি আসা একপ্রকার ছেড়েই দিল। রটে গেল সে ওখানে একজনকে বিয়ে করেছে। কথাটা পুরো সত্যি না হলেও, পুরো মিথ্যাও নয়। বিয়ে করেনি, একজন বিধবা মহিলার সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
        মিনতির ছোটোবোন মালতী পালালো একজন বিহারি জমাদারের সাথে। তার বাবা-মায়ের কোনো হেলদোল হল না। তার মাঝের বোন মুন্নি, একজন সব্জীওয়ালার সাথে ঘুরছে, যে সব্জীওয়ালার বউ, দুটো বড় বড় ছেলে আছে। মুন্নি একদিন রাতে মিনতিকে বলল তার পেটে বিল্লুর বাচ্চা এসেছে। মিনতি অভয়াকে বলল। অভয়া একটা কিসের ফল এনে থেঁতো করে মুন্নিকে খাওয়ালো। বাচ্চাটা মরল। মুন্নির মাথাটা খারাপ হল।
        মিনতি একটা পালাবার পথ খুঁজছিল, এমন সময় তার নীলেশের সাথে আলাপ। ঘাড় অবধি চুল, চোখে একটা উদাস করা ভাব, কালো পেটানো চেহারা, কাঁচরাপাড়ায় ট্রেনে উঠতেই যখন সে মিনতির দিকে তাকিয়েছিল তখনই সে রাজি হয়ে গিয়েছিল মনে মনে।
        বিয়ের পর থেকে অভয়ার যাতায়াত বেড়ে গেল গয়েশপুরে। দু'জন মেয়েকে হারিয়ে, না ঐশ্বরিক অভিনয়ের ক্লান্তিতে – সে যে কোনো কারণেই হোক অভয়া তার বড়মেয়েটাকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইল। সমস্যা হল সুজনকে নিয়ে, নীলেশের বাবা। নীলেশের বাবার চরিত্র পাড়ায় মোটামুটি সবাই কমবেশি জানে। তার অলিখিত স্ত্রী'র সংখ্যা নাকি একশো আট। গুজব অবশ্য। তবে তার জীবনে নারীর অভাব ঘটেনি। সে হেসে বলে, কি করব দাদা একে কুলীন তার উপরে মেয়েদের কষ্ট দেখতে পারি না। বাংলার ঘরে ঘরে মেয়েদের জ্বালা কে বুঝবে বলো? বুঝেছিল বিদ্যাসাগর, রামমোহন আর এই সুজনশর্মা!
        সেই সুজনের চোখে অভয়ার দুঃখ ধরা দিল। তপস্যার বলেই হোক কি আর্থিক সচ্ছলতাতেই হোক, অভয়ার রূপ দিন দিন বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। সুজনের ডাকে অভয়ার মনও সাড়া না দিয়ে পারল না। সেদিন মিনতি কিসের একটা উপোষ করেছে। মন্দিরে পুজো দিতে বেরোবে এমন সময় অভয়া এসে উপস্থিত। মিনতি জানে তার আসার কারণ শুধু সে নয়, তার শাশুড়িও খোঁটা দেয় এই নিয়ে। সে মন্দিরের রাস্তায় কিছুটা গিয়ে দেখে তার বাড়ির হাওয়াই চটিটা পরেই চলে এসেছে। আসলে তার অভয়াকে দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল, তায় না খাওয়া সকাল থেকে। ফিরে এসে সে যা দেখে তাতে সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারে না। এই প্রথম সে তার মাকে উলঙ্গ দেখে। বিছানায়, সুজনের নীচে।
        রেললাইন ধরে কাঁচরাপাড়া থেকে কল্যাণীর দিকে যেতে মাঝখানটায় কাটা মাথা আর শরীরটা পাওয়া যায় মিনতির। নীলেশ একবস্ত্রে সংসার ছাড়ে।

        নীলেশ ঈশ্বর চায় না। সংসার চায় না। তার আত্মহত্যা করতে ভয়। তাই সে শুধু নিজেকে কষ্ট দিতে চায়। এতে তার বুকে একটা আরাম লাগে। একদিন তার মিনতির মত সাহস হবে। কিন্তু হয় না। সংসারের মোহ এত সহজে দুর্বল হৃদয়কে ছাড়ে না। নীলেশের চোখে একজন প্রায়ই চলে আসে আজকাল, চন্দ্রাণী। স্টেশানে ফলের দোকান, লোকে বলে নষ্ট মেয়ে। নীলেশের কথাটা শুনলে আরাম লাগে – নষ্ট।