মেয়েটার স্বামী ফুলশয্যায় মদ্যপ হয়ে এলো। গরীব হলে এমন হয়। সমাজ উদাসীন।
সংসারের জোয়াল মেয়েটার ঘাড়ে। স্বামী মাতাল, উদাসীন। পরিবার উদাসীন। পাড়া উদাসীন। সমাজ হাই তুলে সমাজোদ্ধারকদের সাথে ঘোরে, শিথিল পায়ে।
মেয়েটার কোলে বাচ্চা এলো। পূত্র সন্তান। খরচ বাড়ল। শ্রম বাড়ল। বাপের বুকে দুধ হয় না। মায়ের বুকে চাপ পড়ল। স্বামীর হাত, শিশুর মুখ, মাতৃত্বের স্বাদ একলাই পেল। সমাজ ভ্রুকুটি করল। ভুলে গেলো। বাইরে তখন প্রবল গতিতে এগোনো সমাজ। টাকা-পয়সায় পিছলানো রাস্তা।
স্বামী অর্ধেক রাক্ষস থেকে পুরো দানব হল। একটা কালশিটে শুকাতে না শুকাতেই আরেকটা কালশিটে এলো। দুধের সাথে রক্ত এলো। আসে আসুক। তবু বাঁচুক দুধের শিশু। সমাজ একলা ঘোরে বড়লোকের বাড়ির সামনে দিয়ে। দুপুরে ফেরিওয়ালারা হারিয়ে গেছে তেপান্তরে। সমাজ সব ভুলেছে।
আর পারল না। যেদিন বাঁশের চোটে ফাটল মাথা, মেয়েটা ছেলে নিয়ে এলো বাপের বাড়ি, পাকাপাকি।
সমাজ ভ্রুক্ষেপ করল না। আস্তাকুঁড়েতে মাছির আওয়াজ, কার তাতে কি? ভ্রমর গুঞ্জন? সে তো পদ্মবনে!
দিন গেল। বছর গেল। ডিভোর্স? ওসব বড়লোকদের অভ্যেস। মেয়েটা একলা দাঁড়ালো। পারল। ছেলেটা মাধ্যমিক দিল। সচ্ছল না, তবু বিনা হোঁচটেই পথ হাঁটা টাকা হল। সমাজ বলল, বেশ্যা নাকি? মেয়েটা বলল, না রোজগার করি, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে। সমাজ বলল, তাই তো বললাম।
এসব ঘটনা আকছার ঘটে। সে কথা নয়। সেদিন এলো মেয়েটা। শুনলাম তার স্বামী মরেছে দিন সাত হল। তার চোখে মুখে বিন্দুমাত্র নেই শোকের ছায়া। বলল, ভাই, কষ্ট পেয়েছিলাম তার মরণ যন্ত্রণা দেখে, কেঁদেওছিলাম। সমাজ দেখেনি। তার মরার পর শোক তো হল না! সমাজ দেখল।
তার হাতে ধরা চায়ের কাপ, নিতে যাব...গর্জে উঠল সমাজরূপী আরেক বিধবা নারী, "ওর হাতে খাবে চা! জানো না ওর অশৌচ!" মেয়েটা মাথা নীচু করে সাশ্রু নয়নে ঘর বদলালো।
চমকে উঠলাম। কুঁকড়ে এলো বুক। কিসের অশৌচ? এত অত্যাচার সহ্য করে, সব সম্পর্ক ত্যাগ করে যে মানুষটা সামনে আমার, সে অশুচি! তার অত্যাচারক শোষকের মৃত্যুশোকে?
মনে পড়ল, বহুকাল আগে সেই শুচিবাই বিধবা নারীই বরণ করেছিল কোনো এক আত্মীয়াকে নিজের বৈধব্যের বেশে, কোনো এক পুরুষ অভিভাবকের তীব্র সামাজিক প্রতিবাদের জোরে।
হতাশ হৃদয়। একলা হৃদয়, একটা উত্তর খোঁজে, নারীর অধিকার হরণ করল কে? শুধুই পুরুষ - নাকি নারীও দাঁড়ালো সমাজরূপে নিজেকে আড়াল করে।