রান্নার আগুনে চোখে জ্বালা ধরাচ্ছে। তবু চোখটা যতটা খুলে রাখা যায়, খুলে রাখছে। জল কাটছে। আগুনের তাপ।
আগুন শরীর নিল। নাভি ভাসল জলে। শাঁখা ভাঙল। সিঁদুর মুছল। বছর গড়িয়ে বারো পার হল। রান্নার কাজ নিল। বিয়েবাড়ি, শ্রাদ্ধবাড়ি, অন্নপ্রাশন, পিকনিক, মন্দিরের ভোগ…. লেগেই থাকে। মেয়েটা বোবা। ভগবান মেয়ে গড়তে গড়তেও গড়তে পারেনি। গড়ন দেয়নি। গড়ন না হলে ঠিক মেয়ে বোঝা।
চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে আবার বসল। বিয়েবাড়ির রান্না। হঠাৎ কে বলল, জল নিয়ে এলো… এসো এসো গায়ে হলুদ হবে।
সে আগুনের তাপ কমিয়ে দৌড়ে গেল। উনুনের মাটির মত পোড়া বুক। তাপে টাটায়। আবার শান্ত হয়। যাকে আগুনে নিল, তাকে আগলে আছে স্মৃতি। স্মৃতির প্রদক্ষিণও তো জীবন। দেবতাকে প্রদক্ষিণ যদি করা যায়, মানুষকে যায় না? সাতপাক তো মিথ্যাকথা। হয় একপাকেই অনন্ত পাক, নইলে সব পাকই ফাঁকি।
“দিদি, মাছটা তাড়াতাড়ি বসাও।”
তার বিয়েতে মাছ রেঁধেছিল তার কাকিমা। হাত পুড়িয়েছিল। মনে আছে। হেসে বলেছিল, লাগেনি যা।
অষ্টমঙ্গলায় এসে দেখেছিল পোড়ার ঘা। দগদগে। সেদিন ভেবেছিল, পারল কি করে!
এখন জানে প্রতিমা, কিভাবে পোড়ার ঘা লুকিয়ে চলতে হয়।
একগাল হেসে বলল, হয়ে যাবে বৌদি…. তুমি ওদিকে দেখো…..
সব পোড়া ঘা বুক টাটাচ্ছে তখন, গায়ে হলুদের হইহই… বোবা মেয়েটা বিয়ের বয়েস পেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে দেখছে….. যেন ধানকাটা ক্ষেতে ফেলে যাওয়া এক আঁটি ধান। পোকায় কাটা।
“দিদি আলুভাজাটা….”
মা-মেয়ে রাতের অন্ধকারে পাশাপাশি শুয়ে। নতুন বাড়ি। কাজের বাড়ি। অভ্যাস আছে। কাল বাজবে সানাই। মেয়ে বুকের উপর হাত রাখল। ঘুমের মধ্যে। প্রতিমা চাইল আগুন। পুড়ে যাক দু'জনে। খবরের কাগজে পড়েছে চাষীরা জ্বালাচ্ছে নাড়া। ধোঁয়ায় ভরছে চারদিক। চাষীদের নামে নাকি নালিশ জমেছে থানায়। তাদের ধোঁয়ায় ভরে উঠুক সংসার। অবাধ্য নাভি ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলুক সব ভেদ করে। এখনও জানে না, সত্যিই চুরি করেছিল কিনা তার বর। শুধু জানে লজ্জায় গলায় দড়ি দিয়েছিল। কাগজে লিখে, কেউ দায়ী নয়।
প্রতিমা চায় সেও যাক চাষীদের দলে। মেয়েকে নিয়ে। জ্বালাক ক্ষেত। ধোঁয়ায় ভরে যাক সব। সেই ধোঁয়ায় যাবে সে আর তার মেয়ে জল সইতে। ধোঁয়ায় পথে চলা অভ্যাস তাদের। জলকে গিয়ে বলবে, শোধ নিয়েছি। এবার এসো। শান্তিতে।
তাদের নামে নালিশ জমুক থানায়।