সৌরভ ভট্টাচার্য
23 October 2017
হে মহামান্য রামকৃষ্ণ মিশন,
শুনলাম আপনারা নাকি 'প্রথা ভেঙে'
নিবেদিতার জন্মদিন পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খবরটা শুনেই মনে
হল গালে কেউ যেন একটা ঠাস করে চড় কষালো, আর ভিতর থেকে কেউ
একজন যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠে -'উফ' করল। যে যন্ত্রণায় কুঁকড়ালো সে নিবেদিতা। 'নিবেদিতা
রচনাবলী' নয়, নিবেদিতার
স্ট্যাচুগুলো নয়, ঐতিহাসিক রক্তমাংসের মানুষ নিবেদিতা।
যাঁকে আপনাদের মহামান্য তখনকার প্রেসিডেন্ট ব্রহ্মানন্দ তথা আরো সব স্বামীজির
গুরুভায়েরা স্বামীজির প্রয়াণের পর সরাসরি মঠে আসতে বারণ করে দিয়েছিলেন শুধু নয়,
নিবেদিতাকে বলা হয়েছিল যে মঠে তাঁর নামে বিদেশী বন্ধুদের দ্বারা
প্রেরিত যে চেক বা ড্রাফটগুলো আসে সে সব অর্থ যেন তিনি মঠের তহবিলে জমা করে দেন
এবং আরো বলা হয়েছিল যে তিনি যেন খবরের কাগজে একটা বিবৃতি দেন যে তার সঙ্গে মঠের আর
কোনো যোগাযোগ নেই। কাকে বলেছিলেন? মার্গারেটকে, যিনি একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে, একটা
দেশের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা-ভক্তি-আশা নিয়ে নিজের সর্বস্ব অর্পণ করে এদেশে চলে
এসেছিলেন।
ভুল বললাম। সর্বস্ব অর্পণ
করেননি। নিজের বিচার-বিবেচনা-স্বাধীনবোধশক্তি ছাড়তে পারেননি। একটা মেয়ে মানুষের
এতটা স্পর্ধা এতগুলো ব্রহ্মজ্ঞানী, ব্রহ্মতেজী সহ্য করতে
পারলেন না। হায় রে আপনাদের দুর্বল ঈশ্বর আর তার ভীতু অনুগামীর দল! অথচ তারপরে বহু
দেশপ্রেমীর মঠের সাথে যোগাযোগ তথা সন্ন্যাস হওয়ার তথ্য এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
আছে। কিন্তু একজন বিদেশী মেয়েমানুষের এতটা স্পর্ধা বোধহয় বেশি লেগেছিল। তাই তাকে
আদর্শের অজুহাতে কপর্দপশূন্য করতেও আপনাদের বাধেনি।
আমাদের সুনীলবাবু লিখছেন
না, নিবেদিতা ব্রহ্মানন্দকে বলছেন - "মঠের সঙ্গে
রাজনৈতিক কার্যকলাপের কোনো সম্পর্ক নেই। সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। স্বামীজির
সঙ্গে আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে, তর্ক হয়েছে, কিন্তু তিনি তো আমাকে মঠে আসতে বারণ করেননি। মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি
অসুস্থ শরীর নিয়ে আমার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাকে মঠে আসতে বললেন, আমি এলাম, তিনি নিজে আমাকে আহার্য প্রস্তত করে
দিলেন -
ব্রহ্মানন্দ বললেন,
নরেন ছিল পাহাড়ের মতন, সে অনেক কিছু
সামলাতে পারত, এখন মঠের উপর যদি পুলিশের নজর পড়ে তা হলে
সব কিছু তছনছ হয়ে যাবে। এখানে আর কেউ আসবে না। এমনিতেই গোঁড়া হিন্দুরা আমাদের নামে
অনেক কিছু বলে-
নিবেদিতা বাধা দিয়ে বললেন,
স্বামীজি কোনোওদিনই গোঁড়া হিন্দুদের মতবাদ কিংবা হীন কুৎসার
তোয়াক্কা করতেন না। সন্ন্যাসীরা নির্জন জঙ্গলে কিংবা গিরিকন্দরে আশ্রম বানিয়ে
বসবাস করে শুধু আধ্যাত্মিক চিন্তায় নিমগ্ন থাকতে পারেন। কিন্তু লোকালয়ে এরকম মঠ
বানিয়ে থাকলে আশেপাশের মানুষদের সম্পর্কে কি উদাসীন থাকতে পারে? মানুষের অভাব, অনাহার, দুর্বলের ওপর শক্তিমানের উৎপীড়ন, পরাধীনতার
গ্লানি, এই সব বিষয়ে স্বয়ং স্বামীজি বিচলিত হতেন না?
এইসব দূর করার চেষ্টাই কি রাজনীতি?”
ভক্তমণ্ডলী বলবেন এ তো
সাহিত্য। কল্পনা। কিন্তু তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, এর
বিপরীতটাই ঘটেছিল বুঝি? না ঘটে থাকে তবে অনুগ্রহ করে
চুলচেরা বিশ্লেষণ করার নামে এ সত্য আর ধামাচাপা দেওয়ার মতলব আঁটবেন না। আর ভক্তের
গবেষণালব্ধ পুস্তকের চাইতে আমার মনে হয় জাতকের গল্প পড়ে সময় কাটানো অনেক উপাদেয়।
ভক্ত কোনোদিন গবেষক হতে পারে না।
সেদিন নিবেদিতার চারদিক
শূন্যময় মনে হয়েছিল। খবরদার! করুণা দেখাবেন না ভুল করেও। কারণ ভারতের স্বাধীনতার
ইতিহাসে ওর অবদান আপনাদের সম্মিলিত অবদানের চেয়ে অনেক বেশি অন্তত আমার কাছে। তাই
বলছি দয়া করে 'অবলা' অথবা 'কামিনী' অথবা 'জগন্মাতার
প্রকাশ' কোনোটাই ভাবার দরকার নেই নিবেদিতাকে আপনাদের।
তিনি একজন পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন। আবেগে, ভালোবাসায়,
উৎকণ্ঠায়, দায়িত্ববোধে - একজন সম্পূর্ণ
মানুষ। সেই শক্তিতেই সে মানুষটা আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল তো। তার লেখা বই বিক্রী
করে যে টাকাগুলো আপনারা এতদিন কামিয়েছেন বরং সেই আপনাদের কাছে যৎসামান্য অর্থগুলো
কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করুন বা ওর স্কুলে পাঠিয়ে দিতে থাকুন।
আর যে 'রাজনীতির' জুজু দেখিয়ে মানুষটার সংস্পর্শে
অকুতোভয় ব্রহ্মময়ীর সন্তানেরা আপনারা ভয় খেয়ে গিয়েছিলেন, সে
রাজনীতির সাথে আজকের দিনে আপনাদের সম্পর্ক তো কচি-বাচ্চাও জানে। সে প্রসঙ্গ থাক।
শুধু প্রশ্ন, বোধোদয় হতে এত সময় লাগল কেন? নিবেদিতার জীবনের
কোনো গোপন তথ্য ইদানীংকালের মধ্যে বেরিয়েছে তো শুনিনি। কোনো মঠে মিশনে তার ছবি
ঠাকুরের স্বামীজির শিষ্য-শিষ্যাদের পাশে রাখার সৌজন্য, কৃতজ্ঞতা
বোধটুকু এ যাবৎ যাঁকে দেখাননি, কি ভেবেছিলেন আপনাদের
পূর্বজরা, বিদেশী মেয়েমানুষটার এই হঠকারী বালখিল্যতা
সারাদেশ আপনাদের ব্রহ্মজ্ঞানের, ব্রহ্মসাধনায় ভুলে যাবে,
ফুৎকার দিয়ে উড়ে যাবে? কিন্ত আজ বুঝছেন
তো সে হওয়ার নয়! তাই বলছি, প্লিজ মানুষটার ছবি লাগান,
প্রতিটা কেন্দ্রে স্বামীজির পাশে। বিশ্বাস করুন স্বামীজির একটুও
অমর্যাদা হবে না। সত্যের মান থাকবে। আর ভবিষ্যতে সেই থাকে যে সত্যের মান রাখে।
অবশেষে বলি, আমার এ ঔদ্ধত্য ক্ষমা করবেন। আসলে বড্ড যন্ত্রণা হয় এসব দেখলে। আজ
চারদিকে শুধু পোঁ ধরার দল। আমার আবার কোনো পোঁ বেশিক্ষণ টেকে না। মুখে ব্যাথা করে।
তাই ক্ষমা চেয়ে নিলাম যাদের এই লেখা পড়ে খারাপ লাগল। এক্ষুণি ডিলিট করে দিন প্লিজ।
শুধু প্রহসনটা করার আগে খবরের কাগজে একটা বিবৃতি দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবেন প্লীজ। নয়তো মানুষটার আত্মা বলে যদি কিছু থাকে সে বড় কষ্ট পাবে। হয়ত সারা দেশটাকে
বেইমান বলবে। আর আত্মার তো পুং স্ত্রী হয় না, কি
বলেন?