Skip to main content
 
 
তখন স্কুলে পড়ি। সামনে পুজো। রেলকলোনীর পথই আমার বনবীথি। রেলকলোনীর গাছপালাই আমার শান্তিনিকেতন। শ্যামলী, উত্তরায়ণ সবই আমার রেলকলোনী। অবশ্যই কল্পলোকে।
       এই যে আশ্বিন মাস এসে গেল, এই যে তখন চারদিকে একটা পুজো পুজো ভাব, সে ভাব প্রকৃতিতেও কি লাগেনি? আকাশের রঙ কি অন্যরকম নীল নয়? কাশ কি আসেনি? আমাদের কোয়াটার্সের উঠানে কি শিউলি ঝরে পড়ে নেই, সে যতই কিনা সে শিউলি গাছের গা বেয়ে শুঁয়োপোকাদের কম্বল পাতা হোক। সেই সব পরিবর্তনকে আমি কি করে নিজের ভাষায় আনব? কি করে সুরে বুঝব?
       হাতে এসে পড়ল, সুচিত্রা মিত্র আর প্রদীপ ঘোষের আবৃত্তিতে ধরা - ছুটি - ক্যাসেট।
       প্রদীপ ঘোষের "ছুটি" গল্পের শেষ অংশটা পড়া মনে লাগল। কিন্তু সে একটা কষ্ট পাওয়া। মনকে সত্যিকারের ছুটি দিয়ে গেল সুচিত্রা মিত্র। আমি সুচিত্রা মিত্রকে 'আপনি' বলছি না এখন, আমি 'তুমি' সম্বোধন করছি, তার মানে এ নয় যে আমি ওনাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতুম, তার থেকে বেশিই চিনতুম, আত্মগতভাবে।
       এখন সেই ক্যাসেটের কয়েকটা গানের মধ্যে ছিল একটা গান, 'আকাশে আজ কোন্ চরণের আসা-যাওয়া'। এই গানটায় আমার জানলার বাইরের আকাশ, আমার উঠানের উপর আকাশ, আমার রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় সাক্ষী মাথা ছুঁয়ে থাকা আকাশ --- সব একসাথে গাঁথা হয়ে গেল। আমার কোয়াটার্সের সামনের আমগাছটা, শিরীষগাছটা সেই গানের চরিত্র হয়ে উঠতে শুরু করল।
       আরেকটা গান ছিল, 'তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে', এই গানটায় ওই যে 'বিনিসুতোর শিউলিফুলের মালা' কিম্বা ওই যে যেখানে সুচিত্রা মিত্রের গলায় আক্ষেপের মিড়, 'আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে'..... উদাস করে যেত।
       ক্রমে দিন এগোলো, আমার সাথে পায়ে পায়ে এগোলো সুচিত্রা মিত্র। বর্ষায় যখন কালোমেঘে আকাশ ছেয়েছে তখন, 'ওগো আমার শ্রাবণমেঘের খেয়াতরীর মাঝি', 'এই শ্রাবণ-বেলা বাদল-ঝরা' আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সুচিত্রা মিত্রের হৃদয় নিংড়ানো কন্ঠস্বর ছুঁয়ে রবীন্দ্রনাথ বিন্দু বিন্দু সিলেবাসের বাইরে থেকে এসে আমার হৃদয়ে ঢুকছেন।
       'গানের সুরের আসনখানি', কেমন কোমল ছায়া হয়ে আমার সামনে মাঠের উপরে এসে বসেছে। চৈত্ররাতের উদাসীন নিঃঙ্গতায় 'আজি কোন সুরে বাঁধিব' আমার সারাঘরের দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে ফিরেছে। অজানা রহস্যে 'কি ফুল ঝরিল' আমার সমস্ত সত্তাকে জাগিয়ে রাখতে চেয়েছে।
       এই তালিকা কি শেষ হবে? কোনোদিন শেষ হবে না। ততক্ষণে আমি সুচিত্রা মিত্রকে পড়তে শুরু করেছি। কেমনভাবে চলন্ত ট্রেনের মধ্যে তিনি মায়ের গর্ভ থেকে অস্থির হয়ে উঠলেন ভূমিষ্ঠ হবেন বলে। মাঝপথে ট্রেন থামিয়ে হল জন্ম। তারপর থেকে শুরু হল সেকি ছোটাছুটি।
       সুচিত্রা মিত্রের গান না থাকলে জানতাম কি করে বলিষ্ঠ হতে হলে উদ্ধত হতে হয় না? সুচিত্রা মিত্র না থাকলে জানতাম কি করে ব্যক্তিগত জীবনে কোথাও কারোর সাথে আপোষ না করে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথকে সম্বল করে মেরুদণ্ড সোজা রাখা যায়, এমনকি যদি তার জন্য সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে স্বামীকেও বলতে হয়, আর না, এবার আমাদের পথ আলাদা হোক, তোমার হৃদয়ের সাথে আমার হৃদয়ের মিল যদি না হয়, তবে তো বিয়ের মূলমন্ত্রতেই ফাঁকি, ভাঙুক বিয়ে। ভাঙল। শান্তিদেব ঘোষের ভাষায়, এত ঝড়ঝাপটা ওর জীবনের উপরের দিয়ে গেছে, শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের গানকে সম্বল করে ও লড়াই করে গেছে।
       সেই লড়াইয়ের সুর কি ওর গানের উচ্চারণে জন্মায় নি? জন্মিয়েছে। কবি নীরেন্দ্রনাথ বলছেন, দাঙ্গার মধ্যে দাঁড়িয়ে 'সার্থক জনম আমার', গাইতে দেখেছি সুচিত্রাকে, উদ্যত মুষ্ঠি আকাশের দিকে তুলে। শান্ত হয়েছে পরিবেশ। সুচিত্রা দেশে বিদেশে স্বমহিমায়। রাশিয়ায় গিয়ে বলেই দিলেন, গীতবিতানই আমার কাছে কোরাণ, বাইবেল, গীতা। আর গণনাট্যের গান? সেই লরিতে লরিতে রাস্তায় ঘাটে গান গেয়ে বেড়ানো? সব মিলিয়েই তো তিনি না? যখন 'দহন' সিনেমাতে এক বলিষ্ঠ চরিত্রের অভিনয়ের দরকার হল, কেন ঋতুপর্ণ ঘোষের দরকার হল শুধুই সুচিত্রা মিত্রকে?
       অত্যন্ত সাধারণ মানুষের অনুরোধও ফেলতেন না, যদি তা হত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। বৃদ্ধ বয়সে অশক্ত শরীরে ন্যাশেনাল লাইব্রেরি গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত তথ্য এনে দিয়েছেন কোনো এক অখ্যাত নাম না জানা, পরিচয়হীন রবীন্দ্রানুরাগীর প্রশ্নের উত্তরে।
       চাক্ষুষ দেখেছি দুইবার। এক জোঁড়াসাকোয়; দুই চুঁচুড়ায়। আমি গান শুনেছি। সোজা মেরুদণ্ডে বসার ভঙ্গী দেখেছি। সতেজ, সপ্রাণ, শ্রদ্ধাজাত সুর আর ভাষার উচ্চারণ শুনেছি। চিত্তশুদ্ধি হয়েছে।
       আজ নারীদিবসে আমার জীবনের প্রথম রক্তের সম্পর্ক বহির্ভূত, এই অদম্য, অপরাজেয় আত্মীয়, বন্ধু মানুষটির প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাই।
       'আমি চিত্রাঙ্গদা' গানটির, পুজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে / সে নহি নহি, / হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি। / যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সংকটে সম্পদে,.... পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে। / আজ শুধু করি নিবেদন--- / আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্রনন্দিনী...
       কে উচ্চারণ করবে এই আত্মবিশ্বাসে, এই আত্মমর্যাদায় সুচিত্রা মিত্র ছাড়া? কে শিখিয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের গান শুধু মানে কোমল শ্রাবণ নয়, 'এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে'? আর সব শেষে, 'আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু' -র গানে। সেইদিন শুধুমাত্র মৃত্যুকে বিষয় করে একটা গানের ক্যাসেট সাজিয়ে দেওয়া! কে দিত? কার ভাবনায় এমন একটা সুস্পষ্টভাবে রবীন্দ্রনাথের সাংগীতিক রূপ শ্রোতার কাছে ধরা দিত, যা মিস্টিক রবীন্দ্রনাথের বাইরে এক মানব রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে আসত বারবার?
       আমি একটা ক্যাসেটের কথা দিয়ে এ আলোচনা শেষ করব, "নহ মাতা, নহ কন্যা"। এই ক্যাসেটে সেই সব নারীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের সম্ভার সাজিয়েছেন যারা সত্যিই নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বঁধু সুন্দরী রূপসী.....
       সে কৃষ্ণকলি হতে পারে, সে নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ জ্বালিয়ে যেতে পারে, সে হাসির বাণে শেষ কথাকে শ্লেষ দিয়ে বলা অভিমানিনী নারী হতে পারে, সে পড়শিনি হতে পারে, হতে পারে মনোমন্দিরসুন্দরী...
 
       এই হল আমার সুচিত্রা মিত্র। আমার অদম্য, অবাধ্য বন্ধু, আমার রবি ঠাকুরের মিতা। আমার সঞ্জীবনী।