Skip to main content
 
 
 

এ লেখাটা আমি লিখতে চাইছি না, কিন্তু এও জানি, এ লেখাটা না লেখা অবধি আমার শান্তি নেই। কেন লিখতে চাইছি না? কারণ নবনীতা দেবসেন নামটা আমার পরিচিত, জ্ঞাত নাম শুধু না, আমার আবেগের, অনুভবের যে ঘরদোর, তার বাসিন্দা। সে বাড়ির দরজা খুলতে নেই যখন তখন, কিন্তু আজ না খুলেও আমার নিস্তার নেই। কারণ আজ “এলে নয়ন মাঝে”-এর দিন। আজ না খুললে নিজেকে অকৃতজ্ঞ লাগবে। তাই লিখতে বসা। প্রণাম জানিয়ে...
       নবনীতা দেবসেনের সাথে আমার পাঠকগত পরিচয়। কোনো বাড়িতে ঢুকতে গেলে যেমন বাড়ির দরজায় গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর নাম লেখা থাকে, তেমনই প্রতিটা বই, কি লেখার উপরে একটা নাম। যে বাড়িতে ঢুকছি সে বাড়ির পরিবেশের উপর যেমন আমাদের সংকোচ, শ্রদ্ধা, দ্বিধা, ভালোবাসা ইত্যাদি নানা অনুভব হয়, কোনো লেখার মধ্যে ঢোকার সময়েও তাই। 'নবনীতা দেবসেন' লেখা নামের ফলক দেখলেই আমার যুক্তিসত্তা ঢোকার আগে আমার আবেগের 'আমি' ঢুকে পড়ে। আমার অনুভবের 'আমি' হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। সে কবিতা হোক, কি গল্প হোক, কি প্রবন্ধ, কি ভ্রমণকাহিনী।
       কেউ একজন কোথাও লিখেছিলেন ক'দিন আগে, একজন ঔপন্যাসিকই জানেন একটা উপন্যাস লেখা কি কঠিন। কথাটা আমার মনে ধরেনি। একজন মালী, একজন রাঁধুনী, একজন গাড়ির চালক, একজন শিক্ষক, একজন চিকিৎসক, একজন গায়ক – যারাই তার কাজটা নিখুঁতভাবে, সততার সাথে করতে চান তারা সবাই জানেন প্রতিটা কাজ কত শক্ত! এ তত্ত্ব নিয়ে তপন সিনহা মহাশয়ের ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমার কথা মনে পড়ে। যিনি যে কাজটা নিখুঁতভাবে করতে চান সে কাজটা তার সমস্ত সত্তাকে নিংড়েই করতে হয়। এক কলম কবিতা লিখতেও তাই, একটা তুলির টান দিতেও তাই, একটা জটিল যানজটের ছাড়িয়ে একটা যাত্রীবোঝাই গাড়ি বার করে নিয়ে যেতেও তাই। তবে কি প্রতিভা বলে কিছু নেই? আছে, কিন্তু সে প্রতিভাও এই পরিচর্যার অনুশীলন ছাড়া ব্যর্থ।
       মার্কেজ একটা সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, যুক্তির ঘোরের আড়ালে বাস্তবটাকে না দেখতে পারার কথা। কথাটা মনে ধরেছিল। দর্শনে কোথাও একটা তীক্ষ্ণ যুক্তির দিক থাকে, কোথাও একটা ভাবের গভীরতা থাকে। নবনীতা দেবসেনের লেখায় এই আটপৌরে জীবনের খাঁজে খাঁজে ভাবের গভীরতা মুগ্ধ করেছে। টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের বর্ণনার মধ্যে যতটা না কৃতিত্ব, ঘিঞ্জি শহরের ছাদে দাঁড়িয়ে নীচে রান্নাঘরের কুকারের সিটি গুনতে গুনতে সূর্যোদয়ের মাধুর্যকে বর্ণনার কৃতিত্ব অনেক বেশি। এই মাধুর্যকে দৈনন্দিন জীবনের প্রবাহ থেকে আঁজলা ভরে তুলে আনতেন নবনীতা। আমরা বিস্ময়ে তা আমাদের হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতাম, ধরে রাখতে পারতাম না বেশিক্ষণ, তবে সেই মাধুর্যকে নিজের সত্তার সাথে মিশিয়ে নিতে নিতে অনুভব করতাম তিনি “আমাদেরই লোক”।
       আইনস্টাইনকে তার মৃত্যুশয্যায় যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি আদৌ ভীত কিনা জীবনের আসন্ন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে তাকিয়ে। আইনস্টাইন বলেছিলেন যে, এই অসীম প্রাণপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের ব্যষ্টিসত্তার বিনাশ নিয়ে আদৌ চিন্তিত নন। নবনীতা দেবসেন তাঁর শেষ লেখায় তাই বলে গেলেন, কৌতুকের সাথে, সুকুমার রায়কে স্মরণ করে, “জানিস আমি স্যান্ডো করি”। কেন সুকুমার রায়কে স্মরণ? কেন গীতা বা উপনিষদের আত্মার অমরতাব্যঞ্জক কোনো শ্লোক নয়? কেন 'জীব যে একটা রাসায়নিক পদার্থের সমষ্টি তার বিনাশ আছে' – ইত্যাদি কোনো বস্তুবাদী দর্শনের উদ্ধৃতি নয়? কারণ নবনীতা জীবনের উৎসবকে দেখেছেন নিজের প্রাণের স্বচ্ছ-চিরতরুণ স্রোতে। কোনো তত্ত্ব নয়। আর যে মানুষকে স্মরণ করছেন সেই সুকুমার রায় কি লিখছেন তার অন্তিম লগ্নে 'আবোল তাবোল' কবিতায়? "ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর / গানের পালা সাঙ্গ মোর।" একই সুর।
       একি শোকের সুর? হতাশার সুর? নয় তো। এ বলতে চাওয়া --- আমি চললুম, কিন্তু এ উৎসব যেন না থামে। আলো জ্বেলে রাখো, থেমো না। সেনেকা যখন রাজার হুকুমে নিজের মৃত্যুকে ডেকে নিয়ে এলেন নিজেই, তখন ক্রন্দনরত পরিবারের দিকে তাকিয়ে বলতে চেয়েছিলেন, কান্না কি শুধু এই এক লহমার বিচ্ছেদের জন্য? কান্না কি আজীবনের তপস্যা নয়?
       নবনীতা দেবসেন সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের পথের পথিক – কে যায় অমৃতধাম যাত্রী। সে অমৃত আমাদের ইন্দ্রিয় জগতের বাইরে হলেও আমাদের অনুভবের বাইরে নয়। নবনীতা দেবসেন কোনোদিনই আমাদের অনুভবের বাইরে যেতে পারবেন না। আর যা অনুভবের মধ্যে সে কোনোদিন নিঃস্ব হয়ে যায় না, অনুভবই তার মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে উজ্জীবিত রাখে।

       নবনীতা দেবসেনের নানা লেখার মধ্যে আমার সব চাইতে প্রিয় কবিতা আর ভ্রমণকাহিনীগুলো। তার ভ্রমণকাহিনীগুলো যত না ভৌগলিক মানচিত্রের দিশা দেয় তার থেকে অনেক বেশি মানব চরিত্রের নানা বিচিত্রতার মানচিত্র আঁকে। তিনি সবচাইতে বেশি মজা করেন নিজেকে নিয়ে। তিনি সবচাইতে বেশি গোত্রহীন করে তোলেন নিজের অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যাগুলোকে। তিনি কোনো একটা নির্দিষ্ট দর্শনে বা বিশ্বাসে প্রতিদিন সব কিছুকে একই ধাঁচে দেখতে চান না। তার অভিজ্ঞতার সাথে সাথে উপলব্ধির মেরু পরিবর্তন, দিক পরিবর্তন আমাদের আরো কাছের মানুষ করে তোলে তাকে। কারণ আমরা নিজেরাও তাই। আমাদের গোত্রভুক্ত করতে চায় ধর্ম-রাজনীতি আর নানা ‘বাদ’। কিন্তু সে তো আমাদের মুখোশ। আসলে যে আমরা অবশেষে সবাই নানা ভুলভ্রান্তিতে ভরা মানুষ, নবনীতা দেবসেনের কলম তা জানে, তাই নিয়ে মজা হয়, ব্যঙ্গ হয়। যে কথাটাকে সযত্নে লুকিয়ে রাখি, সেই কথাটাকেই সবাই নিয়ে হেসে লুটিয়ে পড়ার সাহস পাই তার তৈরি শব্দবন্ধে। কারণ নবনীতা দেখিয়েছেন মানুষ এসবের পরেও অনেক বড় --- সে মানুষ।
       আর কবিতার কথা? থাক। কবিতারা নিঃশব্দে আজ কবিতার স্বজন যারা তাদের মধ্যে মন্ত্রের মত বেজে চলুক, সে নিয়ে কথা না হোক। কবিতারা তো শব্দের ঊর্দ্ধে। সে নিয়ে আলোচনা না হোক, উচ্চারিত হোক শুধু, শ্বাসের সাথে, বুক নিংড়ে।
       সমাজের নানা উদ্বেগজনক ঘটনায় বারবার সামনে এসেছেন। অভিভাবকের মত কথা বলেছেন। শুভবুদ্ধির কথা বলেছেন। বকাঝকা করেছেন। বারবার উঠে দাঁড়াবার সাহস জুগিয়েছেন। সেও এক মানুষ।
       শেষে একটা কথা বলে শেষ করি। এ আবেগের কথা নয়, এ দায়িত্বের কথা। তিনি বারবার যে কথাটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সে আমাদের বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে। চারদিকে ইংরাজিতে লেখার হিড়িককে খুব একটা প্রশংসা করেননি। বলেছেন, ওতে নিশ্চয় বড় একটা পাঠককূলের দিকে তাকানো যায়, কিন্তু মানুষ কি শুধু পরিণতি আর লাভের কথা ভেবেই কাজ করবে? তার কর্তব্যবোধ থাকবে না? তার দায়িত্ববোধ থাকবে না? নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে বলতে কোথাও তার মধ্যে একটা হতাশার ভাবও লক্ষ্য করেছি শেষের দিকে লেখায়। বাংলাভাষা যতদিন বাঁচবে নবনীতা দেবসেনও থাকবেন, কিন্তু ভয় যেটা সেটা হল ভাষাটাই যদি না থাকে! যেভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে ভাষাটা নিজের জন্মস্থলেই নিজের গুরুত্ব হারাচ্ছে, জমি ছেড়ে দিচ্ছে, তার ভবিষ্যৎ কি তবে? কিন্তু গায়ের জোরে, কৌশল খাটিয়ে এই ভাঙন থামানোর নয়, এর পথ একমাত্র ভালোবাসায়। নিজের ভাষাকে ভালোবেসে তাকে বাঁচিয়ে রেখে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদের মধ্যেই আশা। সেইটাই নবনীতা দেবসেনের প্রতি আমাদের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য হবে। প্রকাশকের মত করে না, পাঠকের মত করে না, এ দায় নিতে হবে শুধুমাত্র নিজের রক্ত আর স্নায়ুর ছন্দের দিকে তাকিয়ে, ছন্দপতন যেন না ঘটে।