সৌরভ ভট্টাচার্য
1 January 2019
সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। এদিকে রাজামশাই কিছুতেই ঘুম থেকে উঠছেন না। মন্ত্রী দুধের গ্লাস নিয়ে দরজায় টোকা দিয়েছেন। সাড়া নেই। রাণীমা মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রসাদ আর কমপ্লান গুলে রাজামশাইয়ের দরজায় টোকা দিলেন, তাও সাড়া নেই। ভুলু সানাই নিয়ে এলো, কুলু ঢোল নিয়ে এলো, মুলু বেহালা, চুলু সেতার নিয়ে একটা ধুমধুমাধুম কাণ্ড হল, তাও কোনো সাড়া নেই। এবার সবার ভয় ভয় লাগতে শুরু করেছে। অবশেষে সবাই মিলে শ্রীধর কবিরাজ আর নারান মিস্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এলো। কবিরাজ আনা হল যদি রাজামশাই এর কোনো কঠিন ব্যামো হয়ে থাকে এই ভেবে। ও বাবা! দরজা তো ভাঙা হল, কিন্তু রাজামশাই কই?
ওরা খুঁজুক, আমি সেই ফাঁকে গপ্পোটা বলে নিই। হল কি, মাঝরাতে রাজামশাইয়ের জোরসে ইয়ে পেয়েছে, মানে বড়টা আরকি। তিনি গুটিগুটি পায়ে যাচ্ছেন সেই ঘরের দিকে, হঠাৎ একটা খুট্ আওয়াজ শুনে থমকে যান। দেখেন তাঁর পায়ের কাছে গুচ্ছের ছোটো ছোটো কি সার বেঁধে যাচ্ছে যেন। তিনি ভাবলেন পিঁপড়ে, কিন্তু একটু বড় যেন, আসলে বারান্দার নীল মৃদু আলোয় ঠাহর করতে পারছেন না। তিনি বড় আলোটা জ্বালতেই চমকে উঠলেন, আরে এ যে মানুষ! বড় ডেঁয়ো পিঁপড়ের থেকে আর এক কড় লম্বা। তিনি বসে পড়লেন মাটিতেই। তারা সব তাঁকে ঘিরে মেঝেতে গোল হয়ে দাঁড়াল। একজন কি একটা যেন বলতে চাইছে। তিনি ঘাড়টা কাত করে কানটা কাছে নিয়ে গেলেন। যে বলছে, সে এদের সর্দার মনে হল, বেশ সাজগোজ করা। সে বলল, আমরা আপনার প্রজা মহারাজ। রোজ রাতে পাহারা দেওয়া আমাদের কাজ।
মহারাজ বললেন, তবে আগে দেখিনি কেন?
সর্দার বললে, আমরা দিনের বেলায় আমাদের গ্রামে চলে যাই যে।
মহারাজ বললেন, কদ্দুর সে গ্রাম?
সর্দার বললে, নদীর বাঁক পেরিয়ে যে ঝাউবন সেই বনের ভিতর দিয়ে আঁকাবাকা পথ আছে, যেতে আমাদের দেড়ঘন্টা লাগে।
রাজা বললে, কাল নববর্ষ, আমি যাব তোমাদের গ্রামে, তোমাদের আপত্তি নেই তো!
সর্দার মুহূর্তে সবাইকে জানিয়ে দিল। দলের মধ্যে একটা হইচই পড়ে গেল। কয়েকজন শশব্যস্ত হয়ে মহারাজকে প্রণাম করেই দৌড় লাগাল। সর্দার বলল, ওরা গ্রামে খবর দিতে গেল।
মহারাজের মনে ভীষণ ফূর্তি। তিনি ইয়েটিয়ে করে, কম্বল চাপা দিয়ে গভীর ঘুমে চলে গেলেন।
ভোরে উঠে দেখেন, তিনি তাঁর রাজশয়নে তো নেই। তিনি শুয়ে একটা ফুলের বিছানায়। মাথার উপর নীল আকাশ। বাঁকাত হতেই দেখলেন সূর্য উঠছে, পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে, তার মাথার কাছেই কি একটা গাছে বসে নানা পাখি নানা মিষ্টি স্বরে শিস দিচ্ছে। মহারাজ তো বেজায় খুশী। কি করে এখানে এলেন আর জানতেই চাইলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে প্রথম পা-টা ফেলতে যাবেন, দেখেন সার দিয়ে সেই ছোট্টো মানুষের সারি। হাতে নানা সরঞ্জাম নিয়ে দাঁড়িয়ে। তিনি আবার সেই ফুলের পালঙ্কে বসলেন। তারা একে একে তাঁকে সাজালো, স্তব গাইল, নাচগান কত কি হল। তিনি সে সবের পর নিজের গলার দুটো হীরে খচিত সোনার হার যেই না আনন্দিত হয়ে তাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন, তারা গ্রীষ্মের দুপুরের ফুলের মত ম্লান হয়ে গেল। তিনি অপ্রতিভ হয়ে বললেন, তোমাদের পছন্দ হয়নি? তারা চুপ। তখন তিনি যেই না আরেকটা অমন হার গলা থেকে খুলতে যাবেন, অমনি সর্দার বলল, আমাদের ওসব দেবেন না মহারাজ। আমরা অপমানিত বোধ করি।
রাজা অবাক, এ কি কথা! তিনি বললেন, তবে?
সর্দার বলল, আপনি কথা দিন আপনি প্রত্যেক বছরের প্রথম দিনটা আমাদের সাথে এই গ্রামে কাটাবেন একা, তাতেই আমরা খুশী।
রাজা কিছুক্ষণ ভাবলেন। বললেন, বেশ তা নয় হল, কিন্তু তোমাদের আমারও কিছু দিতে ইচ্ছা। সর্দার বলল, তবে আমাদের কিছু কারিগর পাঠিয়ে দিন মহারাজ।
মহারাজ বললেন, কারিগর? কিসের কারিগর?
সর্দার বললেন, আকাশটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে, আকাশটাকে আরো নীল করার কারিগর। গাছের পাতাগুলো আরো ঘন সবুজ করার কারিগর যাতে আগের মত হয়ে যায়, সেই কারিগর। পাহাড়ের মাথার উপর বরফ বানানোর কারিগর, দেখেননি বরফ কমেছে কত? কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে। মাটির নীচে কমেছে জল, সেই জল ভরার কারিগর।
রাজা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাই তো, এগুলো খেয়াল করেননি তো আগে। তিনি আরো কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে গেলেন রাজধানীতে। সবাই ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল। সবাই বলল, মহারাজ নববর্ষের উৎসবের জন্য সবাই এসে গেছে। আজ কি দিয়ে সূচনা হবে?
মহারাজ বললেন, সবাইকে বলো ছবি আঁকতে। বয়স্কদের বলো তাদের ছোটোবেলায় দেখা আকাশের রঙটা আঁকতে, জোয়ানদের বলো পাহাড়ের চূড়োয় বরফের ছবি আঁকতে, আর বাচ্চাদের বলো ঘাসের রঙটা তাদের মনের মত সবুজ করে আঁকতে।
(শুভ নববর্ষ। ভালো থাকুন। আনন্দে থাকুন সবাই। আমাদের পৃথিবীটা আরো বাসযোগ্য থাকুক আগামী প্রজন্মের জন্যে।)