‘নাচ গা ঘুমা’ হীরামণ্ডি না। মুম্বাইয়ের এক ফ্ল্যাটে, দুই ‘ওয়ার্কিং উইমেন’-এর গল্প। একজন ব্যাঙ্কে কাজ করে, যার ছোটো বাচ্চা, ইঞ্জিনিয়ার সমঝদার স্বামী আছে। সুখী পরিবার, ছোটো পরিবার। আর তার বাড়িতে যে কাজ করতে আসে, মানে যে বাড়ির সে ‘কামবালি বাঈ’, তার বাচ্চা ছেলে আছে আর মদ্যপ, মারকুটে স্বামী আছে। তাদের নিয়ে গপ্পো।
কিম্বারলে উইলিয়াম ক্রেনশ, একটা বই লেখেন, অন ইন্টারসেকশনালিটি। যদিও এই ‘ইন্টারসেকশনালিটি’ টার্মটা কিছুটা ফেমিনিজম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও আজ এই বিষয়টার প্রসার অনেক অনেক বিষয়ে আলোকপাত করছে। অনেকটা ওই রবীন্দ্রনাথের ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার মত। যেখানে কবি ডেকে ডেকে বলছেন, শুনতে চাইছেন সবার কথা। এও সেই। সামাজিক-অর্থনৈতিক স্তর, লিঙ্গ, চামড়ার রং ইত্যাদির বেড়া টপকিয়ে একে অন্যকে জানা দিয়েই শুরু হয় এই দর্শন। নিজের নিজের 'ভ্যানিটি' ছেড়ে বেরিয়ে এসে অন্যকে জানতে চাওয়ার মধ্যেই নিজের মুক্তি। এই দর্শনের কথা আজ শুনতেই হবে। আজ মুক্তি ব্রহ্মজ্ঞানে না, আজ মুক্তি আনবায়াসড্ হওয়ার সাধনায়।
খুব মজার মধ্যে দিয়ে পরিচালক গল্পটা বলেন। দৈনন্দিন জীবনের সব দিক আছে। হঠাৎ রাগ, রাগের মাথায় হঠকারিতা, অভিমান, অসহায়তা, আকাঙ্খা, ভাঙা স্বপ্ন, তবু স্বপ্ন দেখার, স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার আশা। আর সর্বোপরি আছে পারস্পরিক নির্ভরতা, আস্থা, ভালোবাসা। যা না হলে সমাজের ধাঁচাটা থাকে, আত্মাটা উড়ে যায়।
দার্শনিক সার্ত্রে বলেন, আত্মজ্ঞানের পন্থা হল অন্যের সঙ্গে ইন্টারেকশন। আমি চোখ বন্ধ করে নিজের মধ্যে আলো-আঁধার, কেষ্ট-কালী যা-ই দর্শন করি না কেন, সে আমার ইচ্ছানুগ। আমি একটা কম্ফোর্ট জোনের মধ্যে বাস করে নিজেকে বিদ্যাসাগর, কী বিবেকানন্দ যা খুশী ভাবতেই পারি, সে আমার শখানুগ। এর কোনোটাই আমার নিজের সম্বন্ধে নিজের পরিচয় করায় না।। সে পরিচয় হয় যখন ওই ইন্টারসেকশানালিটির মধ্যে দিয়ে যাই।
গল্প যত এগোয় তত সবাই সবার মধ্যে এক 'কামবালি বাঈ'-এর সন্ধান পায়। একে অন্যের অসহায়তা, সীমাবদ্ধতা, অভাব, বাধ্যবাধকতা, বিবশতাকে বোঝে। নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবার মধ্যে এক 'কামবালি বাঈ' আছে, এই এক অদ্ভুত কমোন প্ল্যাটফর্মের উপসংহারে গল্পটা শেষ হয়। মানুষের জ্ঞান সহমর্মিতা ছাড়া অপূর্ণ। এই কথাটা নতুন করে আবার খুঁজে পাওয়া যায় গল্পটায়।
মুক্তা বারভে আমার ভীষণ প্রিয় মারাঠি অভিনেত্রী। অনেক সিনেমা দেখেছি ওঁর। তবে এই সিনেমাটায় ওর অভিনয় এক নতুন মাত্রার। সিনেমাটার বেশ কিছু ছোটো ছোটো মুহূর্ত মনে থেকে যাওয়ার মত। “ইচ্ছা ছিল ভারতনাট্যম শিখব, বড় নৃত্যশিল্পী হব, কিন্তু যখনই সংসারনাট্যমে ঢুকলাম, সব শেষ হল।” বয়স্ক শাশুড়ির সংলাপটা মনে থাকার মত।
লিখতে লিখতে মনে পড়ল, ‘আইডিয়া অব ইউ’ নামে এ বছরে যে ইংরেজি সিনেমাটা বেরিয়েছে, তার একটা সংলাপের কথা, “সমাজ মেয়েদের খুশী সহ্য করতে পারে না”। সেখানে এক ডিভোর্সি স্বাবলম্বী চল্লিশোর্ধ্ব মহিলার সঙ্গে এক চব্বিশ বছরের বিখ্যাত পপ গায়কের প্রেমে পড়া নিয়ে আমেরিকান সমাজের গল্প। সেখানে সে সমাজ যে কদর্য ভাষায় তাকে আক্রমণ করে, ইতর ইঙ্গিত করে, শুনে মনে হবে সত্যিই পৃথিবীটা একটা আদিম গ্রাম। আবার সার্ত্রের কথায় ফিরি, মানুষের উন্নতি বলে কিছু হয় না, মানুষ যা, তা-ই, সেই মানুষকে জানাই হল আসল জ্ঞান।
একজন মহিলা শারীরবিদ্যা অনুযায়ী যে সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হয়, সমাজের সংজ্ঞার সঙ্গে তার বিস্তর ফারাক। তাই যারা এ পার্থক্যটা দেখতে পান না, তারা দেখতে চান না বলেই পান না। আবার অনেক কিছু দেখতে দেখতে এমন গা সওয়া হয়ে যায় যে সেটা আলাদা করে কেউ চোখে আঙুল দিয়ে না দেখিয়ে দিলে চোখে পড়ে না। এ সিনেমাটা তেমনই।
যে সিনেমাটা নিয়ে আলোচনা করলাম, সেটা মারাঠি সিনেমা, আমাজন প্রাইমে-এ আছে।