Skip to main content

মনের ভাব প্রকাশের অনেক সমার্থক শব্দ থাকে। এই যেমন মূত্রত্যাগেরও আছে। প্রস্রাব করা, পেচ্ছাপ করা, হিসি করা, মুতে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। ইত্যাদি কেন লিখলাম? আরো সমার্থক শব্দ জানি নাকি? হয় তো জানি!

তো, এই শব্দটার দরকার মানব সভ্যতায় নিশ্চয়ই আদিকাল থেকে। ও হ্যাঁ মনে পড়ল, ডান কি বাঁ হাতের কড়ে আঙুল তুলে দেওয়া মানেও তো তাই…. অনুমতি চাওয়া…. বা সঙ্কেত জানানো।

একটু অণ্টোলজিক্যালি দেখা যাক। মূত্র আসলে কি? এটি একটি রেচন পদার্থ। রেচিত হওয়ার জন্যেই সৃষ্টি। সেই এক কোষ থেকে বহুকোষী জীব অবধি সবাই রেচন ক্রিয়া করে। উপাদানের, কৌশলের তারতম্য হয় বটে, কিন্তু তাগিদটা একই থাকে। সার্বজনীন।

আমাদের দেশে এটা খুব একটা লজ্জার কিছু না। মাঠে-ঘাটে, রাস্তায়, দেওয়ালে, ছাদের রেনপাইপের গোড়ায়, জানলা দিয়ে, ঝোপেঝাড়ে… সর্বত্র আমাদের এ অধিকার আছে। প্রস্রাবাগারে যাই না কেন? কারণ ওই একই, ডিম্যান্ড ও সাপ্লাইয়ের মধ্যে বিশেষ ফারাক তো আছেই, তাছাড়াও অনেক সময় প্রস্রাবাগারের অবস্থা যা থাকে সেখানে ক্ষণমাত্র অবস্থান নরকের কল্পনাকে বাস্তবে দেখার সমান।

এ সব তো আছেই। কিন্তু ইদানীং আমাদের মধ্যে, মানে বিশেষ করে হয় তো বা ভারতীয়দের মধ্যে লোকের গায়ে মূত্র ত্যাগের অদ্ভুত প্রবৃত্তি হয়েছে। প্রায়ই পড়ছিলাম প্লেনে উঠেই পাশের যাত্রীর গায়ে, বিমানসেবিকার গায়ে, এমনিই প্লেনের মেঝেতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করে দিচ্ছেন যাত্রীরা। এবং তার সঙ্গে এমন একটা কথাও লেখা থাকছে যে তারা নাকি সেই সময় নেশাগ্রস্ত থাকেন।

এ এক অদ্ভুত যোগাযোগ। আমাদের এখানে কাঁচরাপাড়া শহরে দেখেছি দু ধরণের মদের দোকান আছে। একটায় সামনে গ্রীল দেওয়া, তার সামনে বেশ টাকাপয়সাওয়ালারা বাইক-গাড়ি নিয়ে দাঁড়ান, কেনেন, চলে যান। আরেকটা আছে দেশী মদের ঠেক। গুমটি ঘর। তার দেওয়ালে বিরাট বড় বাঘের ছবি, থাবা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তার পাশে একটা আলতার শিশির মত শিশিতে লালরঙের মদের ছবি, তাতে লেখা টাইগার। সেখানে বেশিরভাগ মানুষ লুঙ্গি পরে ঢুকছেন, কিনছে, ওখানেই কয়েক চুমুক দিচ্ছেন, বেরিয়ে আসছেন।

এখন কথা হল মদ খেলেই যদি লোকের গায়ে হিসি করার ইচ্ছা জাগে তবে তো লুঙ্গি পরা মানুষদের অনেক সোজা না? কিন্তু আমি তো এই এতগুলো দশক এই শহরে যাতায়াত করছি, এককালে ছিলামও, কই দেখিনি তো মূত্র-প্রপাতের ধারায় স্নাত হচ্ছেন সবাই! কোনোদিন দেখিনি। তবে?

তবে ভাবতে হবে না? কেন ওই মানুষটার হঠাৎ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, সিগারেট খেতে খেতে, বসে থাকা মানুষটার গায়ে পেচ্ছাপ করে দিতে ইচ্ছা হল? সে মানুষটা নেশায় আছে বলে, কিভাবে দাঁড়াতে হয় জানে, কিভাবে অঙ্গটা বার করতে হয় জানে, কিভাবে সিগারেটে যাতে আঙুল, মুখ না পুড়ে যায়, সেইভাবে ধরে টানতে জানে, আর কোথায় কখন কিভাবে হিসি কর‍তে জানে না… এটা হয়? ভূপালের ঘটনাটাই বলছি। বলা হচ্ছে যার উপর কাজটা হল সে ছিল মেন্টালি চ্যালেঞ্জড। কিন্তু যে কাজটা করছে? সে? এ নিয়ে অনেক রাজনৈতিক কোন্দল হল। কিন্তু কথাটা তো রাজনীতির না, কথাটা সমাজনীতির। হঠাৎ করে কেন এরকম একটা প্রবৃত্তি আসতে শুরু করেছে আমাদের? বিশেষ করে শিক্ষিত, তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত নাগরিকদের মধ্যে? এ বিকারের কারণ কি? গ্রাম্য কোন্দলে "তোর মুখে মুতে দি" এ কথা শুনেছি। অর্থাৎ কাউকে হেয় করার প্রবৃত্তি হিসাবে এটা আমাদের মানসিকতায় বহুকাল আগে থেকেই আছে। সে তো অনেক কুপ্রবৃত্তিই আমাদের মধ্যে আছে। সেগুলোকে সামাল দিয়েই তো সভ্যতা। কিন্তু হঠাৎ করে এগুলো বেড়ে যাওয়া, বাস্তবায়িত হওয়ার কারণ কি? এত বিদ্বেষ? এত ঘৃণা? কারণ কি?

তাকে ধরা গেছে। এখন সে ভিডিওটা ফেক ছিল এমনও বলা হচ্ছে। কিসের চাপে কি হচ্ছে সে আলোচ্য নয় আমার। কিন্তু এটা তো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, এরকম তো দেখছি প্রায়ই ঘটছে।

মানুষের উপর মানুষের বিদ্বেষ কোন অস্বাস্থ্যকর জায়গায় গেলে এটা সম্ভব! অনেক পুরুষ যৌনক্রিয়ার পরে তার স্ত্রী বা মহিলাসঙ্গী সে যিনিই হোন তার গায়ে মূত্রত্যাগ করেন, এ নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। সে অবশ্যই আরেক বিকার। তার সঙ্গে কিছুটা তো পুরুষ হওয়ার আপার হ্যাণ্ড নেওয়ার প্রবৃত্তি থাকেই। আরো নানা অশ্রুত সব ঘটনায় এক এক সময় মনে হচ্ছে আমরা "এজ অব পার্ভার্সন" এর দিকে যাচ্ছি? এক সময়ে কাম-ক্রোধ-লোভ ইত্যাদি রিপু ছিল। কিন্তু বিশদে বিকার নিয়ে কথা কোথাও বলা হয়নি। আমাদের এখন তো নিত্যনতুন বিকারের সামনা সামনি হতে হচ্ছে। মৃতদেহ নিয়ে ঘরে বসে থাকা দিনের পর দিন, শিশুদের উপর নানাবিধ অত্যাচার, "মিম" এর নামে নানা বিকারগ্রস্ত পোস্ট সোশ্যালমিডিয়ায়, অদ্ভুতসব বিকারগস্ত রিল, গুজবের সৃষ্টি করা, অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে উন্মাদের মত আচরণ করা…. এ সবই তো বিকার এক ধরণের। এগুলো এত বাড়ছে কেন? আমাদের মানসিকস্বাস্থ্য কি সত্যিই বড় একটা চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে?

বিদ্বেষ এক বড় বালাই। অহং এর নেশা আরেক বড় বালাই। লোভ, সফলতা, হেরে যাওয়া, হতাশা…. যাই আমাদের অ্যারোগ্যান্ট করে, সে এক বড় বালাই। এটা বাস্তব যে হিংসা, বিদ্বেষ ছোটো-ছোটো বিষয়কে কেন্দ্র করে বাড়ছে। আমরা কোথাও যেন ছিন্নমূল হচ্ছি। আমাদের শিক্ষাবিধি, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, রাজনীতি সব কিছুই মানুষকে অবশেষে মাধ্যম করতে শেখাচ্ছে, মানুষকেই উদ্দেশ্য করতে নয়। মানুষ একটা সংখ্যা হচ্ছে, মানুষ একটা ব্যবহারের সামগ্রী হচ্ছে, মানুষ কিছুতেই মানুষের জন্য হচ্ছে না, এ সত্যিই দুর্ভাগ্যের, হতাশার। সবাই যদি আমার ব্যবহারের জিনিস হবে, তবে আমার আর নীচে নামতে বাধা কোথায়? বাস্তব এটা। কিন্তু যেটা বাস্তব সেটা তো কাম্য নয়, অন্তত মূল্যবোধের নিরিখে তো নয়ই।