Skip to main content
 


---

মেয়েটা যখন নামল ধুপগুড়ি স্টেশানে 
তখন দুপুরের মধ্যভাগ।
তার কোলে একটা তিন বছরের ছেলে
হাতে একটা সস্তা সুটকেশ।
শীর্ণ দু'হাত, রোগা ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে একটা বেঞ্চে বসল।
ট্রেন চলে গেল।
ফাঁকা স্টেশানে, মা আর ছেলে
মুনিয়া আর বান্টু।

কে মুনিয়া?
পিছিয়ে যাই বছর দশেক আগে।
মুনিয়া তখন স্কুল ছেড়েছে,
চোদ্দ বছর বয়স।
বাড়িতে মা আর দুই বোন,
বাবা চা বাগানে কাজ করে।

সেই বিকালের কথা মুনিয়া আজও ভোলে নি।
বাবা আসল রোশনকে নিয়ে।
লম্বা ফরসা, দেখতে দারূণ
বয়স সাতাশ হবে, বাড়ি পাঞ্জাবে,
 
বললে মুনিয়াকে সে করবে বিয়ে।
মুনিয়ার প্রাণ নেচে উঠল।
জানল কিছু পরে, সে নাকি বাবার হাতে
দিয়েছিল তিন হাজার টাকা
বিয়ের বিনিময়ে।

সে যাই হোক,
তবু তো পাবে দু'বেলা খেতে,
বাঁচবে মাতাল বাবার মারের হাত থেকে
হোক দুর দেশ,
 
তবু সে খুশি হল তাতে।


 

---

হাওড়া স্টেশান সে প্রথম দেখল,
কত আলো, কত মানুষ চারদিকে।
রোশন কত গল্প বলছে,
 
তার গ্রামের কথা, বাবার কথা, দাদার কথা,
তাদের ক্ষেতের কথা, গরুর কথা।
মুনিয়া ভাবছে,
 
একটা স্বপ্নের রাজ্যের সে রাণী,
যেখানে ভাতের গন্ধ বারো মাস।

অবশেষে সে পৌঁছাল তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে,
মনে হল এক যুগ পেরিয়ে সে এল কোন এক নতুন দেশে।
এদের কথা আলাদা, বেশ আলাদা, আচার আলাদা।
তবু সে করল প্রাণপণ,
সে এখানেই গড়বে তার ঘর, নিজের মত করে।
ওদের কথা শিখবে, ভাষা শিখবে, রান্না শিখবে,
ভালোবাসবে সবটুকু দিয়ে।

প্রথম কয়েক রাত, সে রোশনকে চিনল,
অন্য ভাবে, বেশি করে।
স্বপ্নে মিশল ঘামের গন্ধ, খিস্তি মিশল সোহাগে।
তার বুকে পিঠে পাছায় আঁচড় কামড়ের দাগ,
শুকাবার অপেক্ষায় থাকে, সময় পায় না,
আরো হয় দগদগে।

সাত দিন পর
তাকে যেতে হল ক্ষেতে।
মজুর যে কম, বাড়ির বৌ আছে কি করতে!?
গিলতে!?

ও হ্যাঁ, সে আরো জেনেছিল
রোশনের সে একাই নয়, আরো আছে
ভিনদেশের কি সব ভাষায় কথা বলা,
 
ক্ষেতে চষা, রাত জাগা সব মেয়ে।


 

---

সে দিন অনেক রাত।
তার রাতের ঘরে আজ রোশন নেই,
তার বদলে ঢুকল তার দাদা।
পরের ক'রাত শুধুই তার দাদা।
রক্ত লাগা চাদর সকাল বেলায় কুয়োতলায়
ভোর হতেই হয় কাচতে।
তারপর ভোর হলে যেতে হবে ক্ষেতে।
গরুও কম।
লাঙল ধরবে, যুতবে কে?!
এখন সে জানে,
রোশনের আছে আরো বাঁদী
তারাও ক্ষেতে যায় তার সাথে,
তাদেরও ক্ষত-বিক্ষত যোনি, স্তন, পিঠ আর ঊরু।

এরপর রাতে আসল দেওর, তারপর কাকার ছেলে, তার ছেলে - শেষে কাকাও!

শ্বশুরও এসেছিলেন দিনকয়েক।
সে ঘোমটা দিতে চেয়েছিল,
অভ্যাসে না বাঁচতে, সে জানে না,
তবে কাজ হল কই?
দুর্বল শরীরে জোর নেই শ্বশুরের,
তাই সারারাত কামড়ে ছিলেন
বুক, যোনি, পাছা।
মাংস তুলে দিয়েছিলেন কামড়ে
পিছনে এক খাবলা,
এত্ত ভালবাসা!
তাই পরের দিন ক্ষেতে যাওয়া বারণ।
কত বোঝে এরা!

গ্রামের সবাই জানে।
এটাই রীতি, ঘটে আসছে কবে থেকে!
যেন জানে না, সে মেয়ে মানুষ, ন্যাকা!


 

---

বছর গেল।
কতবার বাচ্চা এল পেটে।
'গিরালো' বাচ্চা।
অকারণে মা হয়ে কি হবে?

সেদিন দসেরা।
রোশন এল জনা পাঁচেক বাইরের লোক নিয়ে।
তাকে সাজালো, গোছালো।
সবার সামনে এল নিয়ে।
ওরা হাসল,
 
দেখল, শুঁকল।
হেসে বলল, "হবে"।

পরের দিন তারা নিল তাকে টেনে, ট্রেনে।
স্টেশানের পর স্টেশান গেল।
সে কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে?
জানতেও চাইল না,
যেখানেই যাক-
আছে তো পুরুষ আর আছে তার শরীর,
এই তো দুনিয়া, চিনেছে সে,
তাই প্রশ্নও করে নি কাউ কে?

তবু আশ্চর্য্য, ও কেঁদেছিল
বাড়ি ছাড়ার সময়।
কেন?
এইটাই সে খুঁজে যাচ্ছিল,
 
কেন...কেন...কেন?

যেখানে আসল সেটা নাকি মুম্বাই।
জায়গা হল বস্তিতে।

নানান লোক রাতে দিনে।
সারা শরীর অবসন্ন।
আবার জাগল।
 
ছটফট করল।
পোষ মানল।

এখন তার গলায় ভাত আর
 
যোনিতে লিঙ্গের স্বাদ আলাদা লাগে না।
দুটোই চাই, বাঁচার তাগিদে।


 

---

জন্মালো বান্টু, না অভিষেক,
তার প্রিয় অভিনেতা।
এখন মুনিয়া চায় আরো শরীর, আরো টাকা।
অভিষেককে বড় করতে হবে।

জ্বর আসে কেন?
 
কাশি হয় কেন?
গেল ডাক্তারের কাছে।
চীৎকার করল ডাক্তার-
"কন্ডোম পরতে বলতে কি হয় তোমাদের?"
তারপর অভিষেকের রক্ত পরীক্ষা করল।
একই রক্ত।
ডাক্তার বলল, "মারণ রোগ"।
মুনিয়া হাসল।
সে তো কবে থেকেই।
ডাক্তার এতদিনে জানল?
তাও রক্তপরীক্ষা করে?

তার বস্তির বাড়ির ছাদে রোজ সন্ধ্যেবেলায়
ওঠে সে।
চাঁদের সাথে, আকাশের সাথে কথা বলে।
বা রে, বলবে না?
ওদেরই তো চেনে সে,
সেই ধুপগুড়ি থেকে!
বাকিরা তো এলো আর গেল।

আজ সন্ধ্যেবেলা সে কথা বলল না।
চীৎকার করল- আ... আ... আ...
মনে হচ্ছিল তার চীৎকারে
ওই আকাশের মেঘগুলো যদি যায় চিরে-
তারাগুলো যদি কেঁপে ওঠে-
আকাশটা গলে গলে পড়ে সারা পৃথিবীতে...

হল না কিছুই,
শুধু সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল ছাদে।


 

---

কারা সব দেখা করতে আসল ক'দিন পর।
তার বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করল।
তারপর একদিন কলকাতার ট্রেনে তুলে দিল।

সেই মুনিয়া, আর তার ছেলে বান্টু, ভাল নাম
অভিষেক, তার প্রিয় অভিনেতা।
গ্রামে এল, তখন আশ্বিন মাস
পূজোর এই তো ক'দিন বাকি।

তাকে নিয়ে তুমুল অশান্তি হল গ্রামে।
সে বেশ্যা, তার ছেলে বেজন্মা!
এ তো সত্যি কথাই, নতুন তো কিছু না!

তবু তার মাকে একবার দেখতে ইচ্ছা করেছিল।
তাই আসা।
হ্যাঁ শুধু তাই আসা, সে থাকতে আসে নি
চায় নি।
সে চায় না কিছু আর।
সে জানে তার আছে শরীর,
আর আছে পুরুষ চারিধার।

দিদিরা বলেছে তো,
 
হোম আছে কলকাতায়,
তাদের মত মেয়েরাই থাকে সেথায়।
গ্রামে অসুবিধা হলে, সেখানে যেতে।
খুব ভাল ওই দিদিরা।
সেখানেই তো সে থাকবে,
বান্টু করবে বড়, অনেক বড়।

মুনিয়া তার মায়ের দিকে তাকাল।
গ্রামের সালিশি সভার এককোণে বসে
আঁচলে মুচছে চোখ।
হতভাগা মেয়েছেলে, কি আছে তার সমাজে,
কতটুকু ক্ষমতা তার?
আজ মুনাই সব বোঝে, তার করূণাই হল
তার মায়ের ওপর, ওই পুরুষ মানুষগুলোর উপর।
তারা তার শরীর ঘাঁটতে ঘাঁটতে বুঝলই না,
তার শরীরের নীচে চাপা একটা মন আছে,
আছে? না, ছিল।
তাতে একবুক ভালবাসাও ছিল।
দামী ভালবাসা,
দিতে চেয়েছিল তো সে,
 
নিল কই কেউ?

সে উঠে আসল।


 

---

আবার স্টেশানে এসে বসল।
বান্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল,
ছোট বেলার এক বন্ধু এসে দুধ দিয়ে গেছে লুকিয়ে।
বান্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল মুনিয়া।
তার চোখ দুটো কার মত?
মনে করতে পারল না।
এত পুরুষের ভিড় তার মনে,
ল্যাংটা হলে তো সবই একরকম লাগত তার কাছে।

চারিদিকে প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে।
মুনিয়া দেখল ঠাকুর আসছে।
এখোনো দূর্গার দশ হাত?!
ভালই করেছে, না হলে এত পুরুষের হাত থেকে
বাঁচাবে কি করে নিজেকে?
স্বর্গেও পুরুষের অভাব নেই,
আর খিদে তো তাদের বারোমাস!

আবার সে বান্টুর মুখের দিকে তাকাল।
সে মরবে, বান্টুও মরবে।
তাদের দুজনের শরীরে এইডস।
বান্টু মুনিয়ার চুল নিয়ে খেলছিল।
মুনিয়া ওকে জড়িয়ে খুব কাঁদল,
ওর মুখে মুখ ঘষল, জড়ালো,চুমু খেল।
বলল আমি তোকে ছেড়ে যাব না বাবা
না....না.... না!

ওকে বুকে জড়িয়ে রেল লাইনে শুল যখন
তখন অনেক রাত।
ওই যে দূরে ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছে,
আসছে, আরো কাছে, আরো কাছে..
ওই ওই ওই.....

রেল লাইনের পাশের কাশফুলে রক্ত ছিটকে লাগল।
সাদা কাশ হল লাল।
কিছুটা স্বপ্ন, কিছুটা ভালবাসা
আর প্রচুর রাগ ক্ষোভ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ল।

কাশ কেঁপে উঠল।
হাওয়া উঠল মত্ত হয়ে।
সেই হাওয়ার প্রবল বেগে মেঘ গেল চিরে।
তারা উঠল কেঁপে।

সারা গ্রাম জুড়ে আসল আশ্বিনের ঝড়!

 
 
 
(শুধু নামগুলোই কাল্পনিক)
 
(ছবিঃ সুমন দাস)