(আজ গুরুপূর্ণিমা। সেই সব মানুষের চরণে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই, যাঁরা আলো জ্বালেননি, বরং নিজেই আলো হয়ে জ্বলে, মানুষকে পথ দেখিয়েছেন যুগ যুগ ধরে)
গাছের কোটরে একটা পাখি। নাম জানি না। সে নিজেও বোধ করি জানে না। সারাদিন ওড়ে এ-বন সে-বন। সন্ধ্যের আগে ফিরে আসে। তার তিন কূলে কেউ নেই। তার ছোটবেলার কথার মনে করার চেষ্টা করে যখন, তার মনে হয় এই কোটরের অন্ধকারেই মিশে তার ছোটবেলা।
সেদিন সে নিজের কোটরে ঘুমিয়ে। ভোর ভোর হয়ে আসছে সে বুঝতে পারছে। বাইরে হাল্কা বৃষ্টির শব্দ তার কানে আসছে। এমন সময় শুনতে পেল, কে যেন গাইছে!
এ সুর সে আগেও শুনেছে। কিন্তু সকালের তাড়াতে ভাল করে শোনা হয়নি কখনো। আজ সে আধাঘুমে আধাজাগায় শুনছে। একবার মনে হচ্ছে কেউ যেন তার কোটরের ভিতর থেকেই গাইছে। আবার মনে হল, না তো, এ তো বাইরে থেকে আসছে। তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। বুকের মধ্যে একটা মোচড় দিচ্ছে গানটার সুর। কথাগুলো বুঝছে না। সুরটা বড় করুণ।
উঠে বসল। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। একটা সুন্দর গন্ধ নাকে আসছে। কি ফুল ফুটল? গন্ধটা তো চেনা না!
এমন সময় হঠাৎ করে হাজির হল তার অনেকদিনের চেনা এক বন্ধু - কাক।
কাককে দেখে সে ভীষণ খুশী। বলল, এতদিন কোথায় ছিলে?
কাক বলল, তীর্থে।
সে বলল, সেটা আবার কি? কোনো বনের নাম?
-না না, কেউ যখন নিজেকে খুঁজতে বাইরে যায়, তখন তাকে তীর্থ বলে।
নাম না জানা পাখিটা যেন কিছু বুঝল, কিন্তু কি বুঝল নিজেই বুঝল না। বলল, তা পেলে তুমি নিজেকে?
কাক হাসল। বলল, তোমার কথা বলো। কেমন আছো?
-ভালো আছি। তবে জানো আজকাল ভোর হলেই কি একটা সুর শুনি কানে। সে সুর কোথা থেকে আসছে বুঝি না।
কাক বলল, কিরকম সুর, গাও তো শুনি?
পাখিটা অনেক চেষ্টা করল সুরটা মনে করার। পারল না। শুধু কান্না পেয়ে গেল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে বলল, মনে আসছে না গো।
কাক বলল, প্রাণে যে এসেছে বন্ধু। তোমার চোখে যে ধরা পড়ে গেল।
পাখি চুপ করে থাকল। ছি ছি, এসব আবার বাইরে থেকেও বোঝা যায় নাকি! সে বলল, আর একটা গন্ধও আসে জানো।
-কিরকম গন্ধ? আঁশটে?
-না, মিঠে।
-গোলাপের মত?
-না।
-জুঁই-এর মত?
-না।
এরকম অনেক ফুলের নাম বলল কাক।
পাখি বলল, না না না।
কাক হাসল। পাখি চুপ করল।
কাক বলল, ভাই এবার বেরোলেই তো হয়।
-কোথায়?
-তীর্থে।
-নিজেকে খুঁজতে? কিন্তু আমি যে ওসব কিছু বুঝি না।
-বোঝে না তো ভাই কেউই। শুধু এটা বোঝে, যা বুঝেছে তাতে তার মধ্যে মন টিকছে না।তখন সে বুঝতে না, কিছু একটা অনুভব করতে সে চায়। প্রাণটা হু হু করে তার। বুদ্ধির কথা ভাল লাগে না, মনের সুখ ভাল লাগে না। সে শুধু এমন একটা কিছু চায়, যেটা তার চিরকালের নিজের।
পাখির মনে হয় সে যেন আবার সে সুরটা শুনতে পাচ্ছে। কাকের গলায় যেন সেই সুরটাই। সে হাঁ করে শোনে।
কাক বলে, শোনো বন্ধু, যা যাওয়ার তা কেউ আটকাতে পারে না। কিন্তু যা চিরকালের তাকে তো পাওয়া চাই। না হলে শুধু যাওয়াটাকেই বড় করে দেখবে। যার উপর এই যাওয়া-আসা তাকেই চেনা হবে না। সব মনে হবে ফাঁকি বন্ধু। সে ফাঁদ যে ব্যাধের ফাঁদের চেয়েও ভয়ংকর!
পাখির মনে হল জিজ্ঞাসা করে, সে চিরকালের বস্তুটি কি? ভেবেই মনে হল, না সে তাকে চেনে না বটে, কিন্তু তার আভাস যেন সে জানে। তারই আদলে সব কিছুকেই সে রাখতে চায় চিরকালের করে- তার বাসা, তার শরীর, তার বন, তার ওড়া। কিন্তু সেগুলো তো চিরকালের ছায়ায়, চিরকালের যে, সে তো এখনও অধরা!
হঠাৎ যেন তার মনে হল, কাকের গায়ের থেকেই আসছে সে অজানা গন্ধটা।
সে বলল, দাঁড়াও বন্ধু, আমি ভিতরের কোটরে কিছু ফল রেখেছি, নিয়ে আসি।
কাক হাসল।
সে ফিরে এসে দেখে, কই কাক? কেউ তো নেই! তার সারা কোটরে সেই গন্ধটা ম ম করছে, আর সুরটা তীব্র হয়ে তার বুকের সব তন্ত্রী ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে!
সে কোটরের বাইরে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ মনে হল আকাশ, বন, মাটি সবাই যেন তার মুখের দিকে চেয়ে তাকে কিছু একটা বলছে। সে উড়ে গেল। আর কোটরের দিকে ফিরে চাইল না। সেই সুর তাকে পথ দেখালো। সেই গন্ধ তাকে ঘিরে রাখল।
(ছবিঃ সুমন দাস)