সৌরভ ভট্টাচার্য
20 February 2019
“তোমাদের তিন বোনের মধ্যে সন্ধ্যাই বুড়িয়ে গেল।”
সন্ধ্যা হাসল। কিছু বলল না। মঙ্গল সুজাতার দিকে তাকাতে সুজাতা চোখের ইশারা করল। মঙ্গল উঠে উঠোনে গিয়ে একটা বিড়ি ধরাল। ঠাট্টাটা ভুল জায়গায় বিঁধল। সন্ধ্যা ছোট শালী। ওদের বাড়ীতেই মানতের কালীপূজো। বিয়ের চার বছর পরেও বাচ্চা হচ্ছিল না বলে সন্ধ্যা মানত করেছিল। ছ’বছরের মাথায় মেয়ে হল --- কলি। এখন বারো বছর। সন্ধ্যার বর নব পেশায় চাষী। যদিও হাঁস-মুরগীর ব্যবসাতেও লাভ কম নেই। সাথে বড় বড় দুটো পুকুর।
সুজাতা একটু দূরে বসেছিল। সন্ধ্যার পাশে এসে বসল। পূজো চলছে, ঘরের মধ্যে ধোঁয়া ধোঁয়া। পৌষমাস। কালীমুর্তিটা গ্রামেই বানানো। সন্ধ্যা বলল, “সত্যিই বুড়িয়ে গেলাম। রাত তিনটে থেকে কী যে পায়খানা সকাল সাতটা অবধি। বছর দেড়েক হল কত ডাক্তার তো দেখালাম বল?” সুজাতা বলল, “ওরম হয়। ভাবিস না।” সুজাতা মা কালীর দিকে তাকাল। সুজাতা মিথ্যা কথা বলল।
নব পুকুরধারে এসে বসেছে। অন্ধকার চারদিক। শীতটাও জাঁকিয়ে পড়েছে। খট্ করে আওয়াজ হতে পিছন ফিরে তাকাল। মঙ্গল দাঁড়িয়ে। নব বলল, “বোসো দাদা।” মঙ্গল বসতেই টের পেল নব মদ খেয়ে আছে। মঙ্গল বয়সে বড় হলেও উপার্জনে অনেক পিছিয়ে। জোগাড়ের কাজ করে। সুজাতা লোকের বাড়ী কাজ করে। তার একটা ছেলে, একটা মেয়ে। মঙ্গল নিজে না মিথ্যে বললেও, বা অন্যায় না করলেও অন্যের মিথ্যে বা অন্যায় আটকাতে তার কোথাও একটা বাধে। নিজের টানাটানির সংসারের জন্য হোক, কিম্বা নিজের স্বভাবের জন্যই হোক, টাকাকে সে শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
নব দেশি মদের একটা বোতল মঙ্গলের সামনে রাখল। মঙ্গল জানে এই সময় নবকে সে যা বলবে নব মনে রাখবে না পরে। নব’র খুড়তুতো ভাইয়ের বউয়ের সাথে একটা অবৈধ সম্পর্ক আছে। গ্রামের সবাই জানে। খুড়তুতো ভাইটা খানিক নিজের চরিত্রের জন্য, আর নব’র ক্ষমতার জন্য জেলেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। তার ছেলে বিল্লোকেও নাকি লোকে বলে অনেকটা নব’র মত দেখতে।
“সন্ধ্যাকে একবার ঠাকুরপুকুরে নিয়ে গেলে হত না?”
নব গায়ের শালটাকে মাথার ওপর টেনে বলল, “ধুর বাল...। ও খানকি এমনিতেও মরবে, ওমনিতেও মরবে। পোঁদে ক্যান্সার, বুঝেচ দাদা।”
মঙ্গল একটা গভীর শ্বাস ফেলে পুকুরের ওপর জমে থাকা কুয়াশার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘরের ভিতর থেকে উলুর আওয়াজ আসছে। ধূপ-ধূনোর গন্ধ আসছে। একটা মেয়ে কয়েকদিন পর মারা যাবে, রোগটা জানা, অথচ তার চিকিৎসা হবে না --- মঙ্গল মদের বোতলের ছিপিটা খুলতে গিয়ে দেখে, ছিপিটা খোলা। নেশার ঘোরে নব তাকে একটা ফাঁকা বোতল দিয়েছে।
“কি জানিস দিদি”, সন্ধ্যা বড় বড় দুটো চোখ মেলে দুর্বল দৃষ্টিতে সুজাতার মুখের দিকে তাকাল, “তোরা এসেছিস বলে তাও দুটো কথা বলছে। নইলে তো মাধবীর বাড়ীতেই এখন রাতেও পড়ে থাকে। আমাকে বলেছে, এই মানতের পূজো হয়ে গেলে যেদিকে দু’চোখ যায় বেরিয়ে যাবে... কিন্তু মেয়েটা...”, সন্ধ্যা কলির দিকে তাকাল। পাড়ার একটা মহিলার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। অঞ্জলীর সময় ডেকে দিতে বলেছে। কলি খায়নি সারাদিন। মায়ের জন্য উপোস রেখেছে। সুজাতা সন্ধ্যার হাতটা নিজের কোলের ওপর এনে রাখল। হাড়ের উপর একটা চামড়া জড়ানো। পিতলের ঘটির গায়ের মত ঠান্ডা। সুজাতা জানে সন্ধ্যার কি হয়েছে। মঙ্গল বলেছে। কিন্তু চিকিৎসা করাবে না। সে চেয়েছিল, সন্ধ্যা তার কাছে গিয়ে থাকুক। সে নিজেই যথাসাধ্য চিকিৎসা করাতো, কিন্তু সন্ধ্যা আসবে না।
“আমি কোথায় যাই বলত দিদি?” সন্ধ্যা ঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে। তার চোখ থেকে শীর্ণ একটা জলের স্রোত, “যা হোক আর কিছু না থাকুক দড়ি-কলসী তো আছে।”
“এমন নির্লজ্জ মাগী যা ভোগে আমি হলে কবে গলায় দড়ি-কলসী দিতুম মঙ্গলদা।” নব উঠে দাড়াতে দাড়াতে শালটাকে এক ঝটকায় পিঠ অবধি জড়িয়ে কথাগুলো বলতে বলতে হাটতে লাগল। মঙ্গল তাকালো না, শুধু অন্ধকার থেকে শেষ কথাটা ভেসে আসল, “বাড়ীর কেউ খুঁজলে বোলো যেখানে থাকার সেখানেই আছে। যেন বিরক্ত না করে।” মঙ্গল বোতলটা পুকুরের দিকে ছুড়ল। ছপাং করে একটা আওয়াজ হল। মঙ্গল কল্পনা করছে বোতলটা ডুবতে ডুবতে জল ভর্তি হয়ে পুকুরের তলায় মাটির ওপর এসে পড়ল। ধীরে ধীরে মাটির মধ্যে মিলিয়ে গেল। সন্ধ্যার মত।
শিয়ালদায় দুপুরবেলাটা ফাঁকাই থাকে। শান্তিপুর লোকালে জানলার পাশে মুখোমুখি সুজাতা আর মঙ্গল বসল। সুজাতার চোখদুটো সারা রাস্তা কেঁদে লাল। একটা কথাও নিজেরা বলেনি। বেলঘরিয়া পেরোনোর পর মঙ্গল বলল, “বাদাম কিনব? সকাল থেকে কিছু তো পেটে পড়েনি।”
আসলে পূজোর পরের দিনই সন্ধ্যা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। সেদিনটা থেকে তারা পরদিন রওনা দিয়েছে ভোরবেলায়। দমদম থেকেই ট্রেন পাল্টাত, কিন্তু সুজাতা বলল, সে ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে পূজো দিয়ে আসবে।
সুজাতা একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, “কেনো...” মঙ্গল দু’প্যাকেট বাদাম কিনল। বাদামটা গিলতে গিয়ে সুজাতা বুঝল গলাটা শুকনো কাঠ। কোনরকমে চেবানো মণ্ড বাদামগুলোকে গলা দিয়ে নামিয়ে মঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক হয়ে যাবে বলো? সন্ধ্যা বলছিলো...” সুজাতা থেমে গেল। ট্রেনের আর হকারের আওয়াজে মঙ্গল শেষের কথাগুলো শুনতেই পায় নি। সুজাতা মঙ্গলকে না জানিয়েই দেড় হাজার টাকা সন্ধ্যার হাতে দিয়ে এসেছে। যা থাকে কপালে। মঙ্গল ব্যারাকপুর ছাড়ার পর সুজাতার পাশে এসে বসল। বলল, “আজকের দিনটা বিশ্রাম নিয়ে চল কালকে কলকাতায় আসব।” সুজাতা ভুরু কুঁচকে মঙ্গলের দিকে তাকাল। মঙ্গল বলল, “ওকে চিত্তরঞ্জনে পাঠাচ্ছে ওই হাসপাতাল থেকে, নব ফোন করেছিন।” সুজাতা বলল, “চিত্তরঞ্জন?” মঙ্গল বলল, “পার্ক সার্কাসে, কলকাতাতেই। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি থেকে যাব ক’দিন।”
মঙ্গল সন্ধ্যাকে দাহ করে ফিরে দেখে সুজাতার জ্বর। তিনদিন হল ছাড়েনি। ঘোরের মধ্যে সে বারবার বলছে, “ওর কাছ থেকে দড়িটা সরা... দড়িটা সরা...” মঙ্গল সুজাতাকে জড়িয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, “দড়িটা সরিয়ে এসেছি। তুমি আর ভেবো না।” মঙ্গলের চোখের জল সুজাতার কপাল বেয়ে বালিশে পড়ল। মঙ্গল সুজাতার কানে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “নব’ও কেঁদেছিল। নব’ও কেঁদেছিল... টাকাটাই সব নয় সুজাতা।”
সুজাতা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কথাগুলো মঙ্গল যেন নিজেকেই নিজে বলল। নবকে ফোন করল। বলল, “নিজের খেয়াল রেখো, ক’দিন এখানে এসে ঘুরে যেও। ভাল লাগবে।”
এই প্রথম নিজেকে তার নব’র থেকে বড় মনে হল।