টিলাটার উপর কবে উঠেছিলাম মনে নেই। তবে তোমায় আরো কাছ থেকে দেখব বলে উঠেছিলাম এতদূর মনে আছে। এই নির্জনে নিজেকে নির্বাসিত করে রেখেছিলাম শুধু তোমায় আরো কাছ থেকে জানব বলে। হ্যাঁ মৃত্যু তোমাকেই বলছি। তুমি ছিলে রহস্য। বহু মূল্যবান সম্পদ কেড়েছ বিনামূল্যে। একটা ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার মুখোশের আড়াল তোমার। ইচ্ছা ছিল, জেদ চেপে গিয়েছিল ওটাকে টান মেরে খুলে দেওয়ার।
কতদিন এই টিলাটায় কাটলাম সত্যিই মনে নেই। এখন দেখছি চারদিক ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে, এখনি গভীর রাত নামবে। রহস্যময় সেও। মৃত্যু, কোথায় তুমি? কোনো পায়ের শব্দ, কোনো ডাক, কোনো স্পর্শ – কিছুই তো পেলাম না। কই তুমি?
হঠাৎ আমার চোখের সামনে থেকে উঠে গেল একটা পর্দা। এই এই মাত্র হল। আমার অট্টহাসিতে কেঁপে উঠল আকাশ, বাতাস, ঘন জঙ্গলের উচ্চতম গাছের পাতাগুলোও। প্রহেলিকা? অ্যাঁ! হাঃ...হাঃ...হাঃ...এই তোমার আসল রূপ তবে?! বলছি শোনো।
এই যে খানিক আগে সূর্যাস্ত হল, অন্ধকার গুটিগুটি পায়ে এলো চোরের মত। এ কথা কি সত্য বলে মানি আজ? কখনও না। আলো শেষ হওয়ার পর যা থাকে সেই অন্ধকার। সে কোনো অস্তিত্ব না, সে অভাব। আলোর অভাব। মৃত্যু তুমিও তাই। জীবনদীপ নির্বাপিত হলে তোমার সাজ। এত আয়োজন, এত উৎসব, এত আলো, এত উচ্ছ্বাস - এ সব সব জীবনের। যা কিছু চারদিকে দেখছি সবই জীবনের সৃষ্টি, জীবনেরই জন্য। ভালো-মন্দ, পাপ-পূণ্য, আনন্দ-বিষাদ, ভয়- অভয়...সব জীবনের রূপ মৃত্যু, তুমি কিছু নও। কিছু না। তুমি ধাঙড়। তুমি ময়লাকুড়ুনি। জীবন থাকতে এ শরীরে তোমার কোনো অধিকার নেই মৃত্যু, তোমার অধিকার নিথর দেহে। আমি শরীর নই। আমি শরীরের মধ্যে থাকা এই প্রাণ। আমি জীবন। পরজন্ম আছে কিনা জানি না। আত্মা আছে কিনা জানি না। আমি যে আছি সেটুকু জানি শুধু। আর আমায় ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে এ বিশ্বসংসার। তাকে প্রতি মুহুর্তে পাচ্ছি আমার প্রাণের করপুটে। সেখানে ভয় নেই। সেখানে দেওয়া-নেওয়া আছে। ছন্দ আছে। মাঝে মাঝে ছন্দপতন আছে। ভুল আছে। কিছু ভুল ঘিরে কয়েকটা ঠিকও আছে। প্রতিদিন নিজের মধ্যে নিজের হয়ে ওঠা আছে, আবার প্রতিদিন নিজেকে একটু একটু করে ছেড়ে যাওয়াও আছে। ঘরে বাইরে এই যে নানান চেষ্টা, সে তোমার ভয়ে নয়, তোমার অনস্তিত্ত্বে। তুমি নেই। মৃত্যু বলে কিছু হয় না। যা হয় তা শুধুই জীবন। আর যদি কিছু পরজন্ম বলে থেকেও থাকে, তবে সেও আরেকটা জীবন। সত্যেরই -তর, -তম হয়, মিথ্যার হয় না। তুমি মিথ্যা। তুমি অনস্তিত্ব। সংসারে তুমি নেই, আছে প্রাণের অজ্ঞতার ভয় তোমায় নিয়ে, যেমন শিশুর ভয় অন্ধকারে জুজুবুড়ি নিয়ে। তুমি মিথ্যা, মিথ্যা মিথ্যাই অনাদিকাল জুড়ে। প্রাণহীন শরীরকুড়ানি। ধাঙড়। আজ তাই আর যাই হোক, ভয় রইল না। জীবনের প্রতিটা লগ্ন ভরে উঠুক শুধু জীবনেরই ধর্মে - এই প্রার্থনা। প্রকাশিত হওয়া প্রাণের স্বভাব মৃত্যু, তোমার নয়! আর প্রণাম জানাই সেই সব জ্ঞাত অজ্ঞাত মহাপ্রাণদের যাঁরা এই সত্যের জ্বলন্ত মূর্তি হয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন করছেন অজস্র দুর্বল প্রাণকে।
(ছবি - গুগুল)