Skip to main content

 জেঠু মারা গেলেন অল্প বয়সে। হঠাৎ করে, সেরিব্রাল অ্যাটাক। বাংলার বাইরে। ঠাকুমা বললেন, আর ঈশ্বরের মুখ দেখবেন না। বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী থাকবেন উপোষী। সোমবার শিব থাকবেন অস্নাত, অর্মাজিত। তাই হল।

      দুর্গাপুজো এলো। ঠাকুমা মণ্ডপে গেলেন না। দেবীর মুখ দেখবেন না। কিন্তু প্রতিবছর তো ঠাকুমাই পাড়ার ঠাকুর বরণ করেন, তার বেলা? পাড়ার ছেলেরা এল, ঠাকুমাকে জোর করল। অবশ্যই যেতে হবে। যেতেই হবে। নইলে ঠাকুর নামবে না।

ঠাকুমা রাজি হলেন। সঙ্গে চললেন মা আর জেঠিমা। ঠাকুমার মুখের প্রত্যেকটা পেশী স্বতন্ত্রভাবে কঠিন। চোখের দৃষ্টি পাথরের উপর পড়া বর্ষার জলের মত টলটলে। ঠাকুমা মণ্ডপে পৌঁছালেন। অশৌচের কথা কেউ উচ্চারণ করল না। জেঠিমার সদ্য বৈধব্যের কথা কেউ উচ্চারণ করল না। পাড়ার একজন এগিয়ে এসে একটা চেয়ার দিলেন ঠাকুমাকে। দাঁড়াবেন ওর উপর।

      ঢাকিরা ঢাক বাজাতে শুরু করল। কাঁসর বাজতে শুরু করল। ঠাকুমা আমার হাত ধরে চেয়ারে উঠলেন। প্রতিমার মুখের দিকে তাকালেন। স্থির দৃষ্টি। অপলক দৃষ্টি। প্রতিমাও মাথাটা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে, ঠাকুমার চোখের দিকে। কেউ কোনো কথা বলছে না। ঠাকুমা উলুধ্বনি করে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার সব বউ, মেয়েরা উলুধ্বনি করে উঠল। শাঁখ বেজে উঠল। এইবার ঠাকুমার স্বতন্ত্র পেশীগুলো ক্রমে শিথিল হচ্ছে। চোখের কোল উপচে জল পড়ছে গাল গড়িয়ে। জেঠিমা বরণডালা হাতে স্থির তাকিয়ে শাশুড়ির দিকে। মা আঁচলে মুখ চেপে কান্না আটকাচ্ছেন। আমি ঠাকুমার কাছাকাছি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি, যদি পড়ে যান!

      ঠাকুমা পড়লেন না। সারা শরীরটা অল্প অল্প দুলিয়ে দুলিয়ে নাচের ভঙ্গীতে কান্না মেশানো বরণ শুরু হল। ঢাকের তালে তালে সে নৃত্যভঙ্গীতে বাচ্চাগুলো দুপাশে নাচতে শুরু করল। তাদের ঠেকাতে ভলেন্টিয়ারের দল। এরপর জেঠিমা বরণ করলেন। মা বরণ করলেন। তারপর পাড়ার আরো সবাই।

      বরণ শেষ হল। ঠাকুমা ফিরছেন, পাশে আমি। এখন খেয়াল করলাম ঠাকুমার খালি পা। সালকিয়ার এই নোংরা গলিতে পায়ে কুকুরের গু লেগে যাবে না? কিন্তু ঠাকুমার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বললাম না। যেন একটা মানুষ স্বপ্নে হেঁটে যাচ্ছে। পাশে আমি। আমার পাশে দিদি। পিছনে মা, জেঠিমা।

      ঘরে ঢুকে ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে উপুড় হয়ে পড়লেন। গোঙানি আর কান্না মিশে এক বুকফাটা শব্দ। মা আমায় ইশারা করলেন বাইরে চলে আসতে। ছাদে গেলাম। ছাদ থেকেও শুনছি ঠাকুমার ঘড়ঘড়ে কান্নার শব্দ। নানা জায়গায় মাইক চলছে। মানুষের সংসারে মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে কান্না লাগে। অনেক কান্না লাগে।

 

      আজ ঠাকুমা নেই, ঠাকুর্দা নেই, মা নেই। এতো গেল আমার ছোটো সংসারের ছোটো গল্প। চেনা গল্প। কিন্তু আজ? আজ তো মৃত্যু পারিবারিক গল্প না। আজ মৃত্যু অতিমারি। এই এক বছরে কত কত পরিবার শূন্য হয়ে গেল। মানুষের ঘরে-বাইরে মৃত্যুর আতঙ্ক। তার মধ্যেও আমাদের কোর্টের শাসন দরকার হয়, আমার ভালো বুঝতে, বোঝাতে। সেদিন আমার পরিবারে যা ঘটেছিল, আজ হাজার হাজার পরিবারের সেই অবস্থা। সেদিন আমাদের সেই সালকিয়ার পাড়ার আন্তরিক ডাক ছিল। আমাদের পারিবারিক শোককে উপেক্ষা করেনি কেউ, শোকের বাইরে এসে সবার মাঝে দাঁড়াবার আহ্বান ছিল, সংস্কারের বাধা উপেক্ষা করেও। কিন্তু আজ এই ভীষণ বিষণ্ণতার দিনে, যেখানে পরিবারের পর পরিবারে শোকের সঙ্গে লড়াই, আকস্মিক কর্মহীনতার জটিল পরিস্থিতি, সেখানে আসলে আমরা কিসের উৎসব করছি? কার জন্য করছি? শুধু আমার জন্য, যে আমি এখনও এই অতিমারির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ গ্রাস থেকে বেঁচে আছি? এমনই জড়-অভ্যাসের গতি আমাদের, থামাতে চাইলেও থামে না?

      আজ বহুদিন পর আমি আবার ঠাকুমার সেই কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। অনেক অনেক মাইকের আওয়াজে সেদিন যেমন সে আওয়াজ চেপে যাচ্ছিল, আজও চেপে যাচ্ছে। আরাধনা আর আড়ম্বরের পার্থক্য করতে না পারা একটা জাত ভীষণ বিভ্রান্ত হয়ে বারবার কোর্টের দিকে তাকাচ্ছে, ঘুমন্ত বিবেক কোনো উত্তর দিচ্ছে না যে! শুধু প্রথা-ঐতিহ্যের ভারের গতিতে দিশাহীন দৌড় একটা, কিন্তু কেন?