গামছা কিনতে গিয়ে শেষ ট্রেনটা মিস হয়ে গেল অলোকের। বউটা এলো না। হাঁটুতে ব্যথা। কাঁচরাপাড়া স্টেশানে বসে অলোক। শ্রীগুরু আশ্রমে গিয়েছিল। বউ আর সে দু'জনেই এখানে দীক্ষিত। বেরিয়েইছিল ঠিক সময় দেখে, ফুলিয়ায় বাড়ি। কিন্তু গামছাওয়ালাটা পায়খানা পেয়েছিল বলে দেরি করল। গরীব মানুষ, পুজোগণ্ডার দিনে না কিনে চলে আসবে? বাজে দেখায়।
অলোক বসে একটা বেঞ্চে। কেউ কেউ ঘুমাচ্ছে। কেউ কেউ এদিক ওদিক বসে। আরপিএফ ঘুরে বেড়াচ্ছে। অলোক চারদিক তাকিয়ে চোখটা বন্ধ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। স্টেশানের উল্টোদিকে একটা কালীমন্দির। অলোকের কি মনে হল, স্টেশান ধরে হাঁটতে শুরু করল। ইচ্ছা মন্দিরে যায়। সামনে সিগন্যাল লাল। এখন কোনো গাড়ি নেই। লাইন পার হল। মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। মায়ের মুখটা ভীষণ সুন্দর। যেন ভোরের শেষ তারা। প্রণাম করে উঠতে যাবে, একজন পিছন থেকে বলল, প্রসাদ নিয়ে যা।
অলোক ঘুরে দেখে একজন গেরুয়া পরা লোক। তার হাতে একটা বাতাসা দিয়ে বলল, তুই শ্রীগুরুর আশ্রমে গিয়েছিলি না?
অলোক হাঁ করে তাকিয়ে বলল, আপনি…
সে বলল, আমি ওখানেই ছিলাম, তুই গামছা কিনলি, পাঁচটাকা ফেরত নিলি না। গামছাটা ভালো।
মাঝরাতে সন্ন্যাসীর সঙ্গে গামছা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করল না অলোকের। কিন্তু কিছু তো একটা করতে হবে। সে মাথা নেড়ে বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
সে হেসে বলল, কাশী… আমায় মৃত্যুনদা বলে ডাকতে পারিস… গেরুয়া দেখে সাধুটাধু ভাবিস না… এসব ভেক… আসলে আমি ভণ্ড…খুনটুন করেছি কিছু… এখন ছদ্মবেশে ঘুরি…
অলোকের গলা ধাঁ করে শুকিয়ে গেল। স্টেশানের দিকে তাকালো। পুলিশ ছিল না? এখন কই?
সন্ন্যাসী, ওরফে মৃত্যুন, ওরফে খুনি 'হো হো' করে হেসে ফেলল, বলল, মনটা কেমন ধন্দে ফেলে দিলাম না? শুরুতে যেমন শ্রদ্ধা ছিল হুস্ করে উড়ে গেল না? এত সহজে তোদের বিশ্বাস হয় আর যায়… কেউ একটা বলে দিল এই কুড়ি হাতের জাগ্রত কালী কি মনসা… অমনি সব হামলে পড়লি… এত বোকা হলে সবাই ঠকাবে যে রে… বোস বোস… আমি খুনিটুনি কিছু নই…আমি সাধারণ মানুষ একজন… সাধু হয়েছি, তবে সিদ্ধাই নিয়ে ঘুরি না… বোকা হোস না…বোকা হোস না…
দু'জনেই বসল মন্দিরের সামনে।
সন্ন্যাসী বলল, আমার নাম মৃত্যুঞ্জয়। সাতকূলে কেউ নেই। এখানে একজনের কাছে মানুষ। শিক্ষিকা ছিলেন। আমায় দত্তক নিয়েছিলেন। তিনিও গেলেন, আমিও সংসার ছাড়লাম। এই পুজোর সময় আসি, মনটা টানে।
অলোকের লজ্জা লাগছিল। তাই তো! মানুষের মন কি বোকা… একটা হুজুগ তুললেই হল, সব হামলিয়ে পড়ে হইহই… অলোক বলল, শান্তি পেয়েছেন?
সন্ন্যাসী হাসল। বলল, তুই চাস বুঝি?
অলোক বলল, চাই। পাই না। ছেলেটার মাথা খারাপ। কি যে হবে আমি আর ও চোখ বুজলে।
সন্ন্যাসী চুপ করে অলোকের দিকে তাকিয়ে থাকল। খানিক বাদে বলল, কিছু জিনিসের ভেবে উত্তর পাওয়া যায় না.. ভাবিস না….
অলোক বলল, তবে কি করব?
সন্ন্যাসী বলল, আবার উত্তর চাইছিস…..
রাত বাড়ল। সন্ন্যাসী চোখ বন্ধ করে বসে। অলোকের বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল।
সন্ন্যাসী হঠাৎ চোখটা খুলে বলল, ইচ্ছা করে আজ ট্রেন মিস করেছিস তো… বাড়ি যেতে ইচ্ছা করছিল না… পালাচ্ছিস…
অলোকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। সে 'হ্যাঁ' বা 'না' কিছুই বলল না…
অলোক একটু পর বলল, আরো খারাপ খারাপ ইচ্ছা আছে….
সন্ন্যাসী চোখটা বন্ধ করেই বলল, গলা টিপে মেরেছিস... গঙ্গায় চুবিয়ে মেরেছিস… আগুন দিয়ে….
অলোক মাটিতে শুয়ে পড়ল। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি ওকে মুক্তি দিতে চেয়েছি গো…
কতগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
সন্ন্যাসী বলল, হাট… যাহ…
অলোক শান্ত হল। বলল, আমি পাপী। নইলে আমারই সঙ্গে কেন?...
সন্ন্যাসী বলল, পাপী নোস, সহজ বোকা…যাদের সহজেই বোকা বানানো যায়… উপায় না খুঁজে টোটকা খুঁজে মরিস তোরা… আর ভগবানকে ভাবিস বোকা যাদুকর… ঠকানো যায়….
অলোক বলল, কি করব আমি?
সন্ন্যাসী বলল, বোকামি ছাড়। উপায় খোঁজ। পাবি। বোকা বিশ্বাসী হলে সবশুদ্ধ জলে গিয়ে পড়বি।
অলোক চুপ করে। সন্ন্যাসীও।
অলোকের ঘুম ভাঙল কারোর ডাকে।
ও মশায়, ওঠেন… মন্দির খুলব যে…
ধড়ফড় করে উঠল অলোক। সাড়ে পাঁচটা বাজে। সন্ন্যাসী কই?
পূজারী মন্দির মুছছে। অলোক জিজ্ঞাসা করল, এক সন্ন্যাসী ছিল…. কই গেল জানেন?
পূজারী বলল, না তো দাদা।
অলোক স্টেশানে এলো। চা খেলো। বাড়িতে ফোন করে জিজ্ঞাসা করল, বাবু উঠেছে?
উত্তর এলো, না ঘুমাচ্ছে।
অলোক বলল, ঘুমাক। আমি আসছি।
গুরুদেব দীক্ষার সময় তার নাম রেখেছিলেন, মৃত্যুঞ্জয়।