বিমর্ষতা একটা কারাগার। বিষন্নতা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এর বাইরে একটা বোধ আছে। শারীরিক কিম্বা অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যেই মানুষ বিষন্ন বা বিমর্ষ হয় - তাও কি একটা সার্বজনীন মতবাদ বা সিদ্ধান্ত বলা চলে, তা তো নয়। সংগ্রাম আর বিষন্নতা একই সাথে চলে। কারোর ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী তাদের প্রাবল্য বদলে বদলে যায়। যে মানুষটা প্রতিদিন মৃত্যুর কথা ভাবে, সব কিছুকে নঞর্থক দৃষ্টিতে দেখে, মোটকথা অত্যন্ত বিষন্ন – সে-ও সোম থেকে শুক্র কিম্বা শনি'র লড়াইয়েও সামিল। লড়াইয়েই কিছু হয় না – হয় এই মনোভাবেই। কিন্তু লড়াইটা সে করছেই। নিজেকে দুটো ভাগে ভাগ করে নিয়ে লড়াইটা চালাচ্ছে।- একদিকে সে ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যুদ্ধক্ষেত্রে সামিল, অন্যদিকে সে মনের মধ্যে একটা বিষন্ন ঘরের বাসিন্দা। চারদিকে “হয় না, হয় না” একটা রব সে বাজিয়েই চলে। এ এক স্বকল্পিত বিষন্নতার দেশ। সে একছত্র অধিপতি।
আসলে মানবিক সত্যে সব কিছু বস্তুনির্ভর নয়, ব্যক্তিত্ব নির্ভর। একই ঘটনার নানা দৃষ্টিভঙ্গী ব্যক্তিত্বের আদলে তৈরি হয়। তাই একদেশের সাহিত্যের সাথে আর একদেশের সাহিত্যের একটা বড় পার্থক্য হয়ে যায় – টোনাল পার্থক্য – মূলসুরগত পার্থক্য - যেমন রাশিয়ান আর ফরাসী। কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সে বিচার অজ্ঞতার বিচার। সবটাই সত্য। নানা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সত্য। মুশকিল হল কোনো একটা বিচার কোণ থেকে অন্যের বিচারের সমালোচনা করাটা – সেটা হয় না। তলস্তয় আর দস্তয়েভস্কির লেখার তুলনা, পার্থক্যমূলক বেশ কিছু বই পড়েছি। তার মধ্যে গুণী-বিদগ্ধজনদের কথাই হল একের সাথে অন্যের তুলনা চলে না। মধ্যমার্গীয়রা একটা পক্ষ নিয়ে নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার্থে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেখানে মূল কথাই হল – অমুককে বড় করতে তমুককে ছোটো করো। ‘দু'জনেই বড় ও অনন্য’ কথাটা তাদের বড় অলীক, শৌখিন, ভীরু, মিথ্যাচার বলে বোধ হয়। কারণ ওই – পক্ষ কি আপনার?
এমন একটা নিটোল সিদ্ধান্তের উপর জীবন দর্শন দাঁড় করিয়ে রাখা অসম্ভব। তার থেকেই মৌলবাদের জন্ম। যদিও এমন কোনো মানুষ হওয়া পারতপক্ষে কঠিন যে ‘কিঞ্চিৎ অপি’ মৌলবাদ মুক্ত। কিছুটা গোঁড়ামি সকলের মধ্যেই থাকে, সেটাই মনুষ্যপ্রকৃতির দুর্বল দিক, তবে তাকে প্রকাশ্যে মূল গতি আর বেগ নির্ধারক না করলেই সমস্যা হয় না। স্বীকার করে নিলেই ল্যাঠা চোকে। কিন্তু অনেকেরই স্থির বিশ্বাস সে সম্পূর্ণরূপে মৌলবাদ মুক্ত। মৌলবাদের ফলিত দিকটা হল – পক্ষপাতিত্ব। “আমার কোনোদিকেই পক্ষপাতিত্ব নেই” – এ আরো ভয়ংকর একটা মৌলবাদ। তাদের কাজই হল সবসময় ‘উদারতা’ নামক ব্র্যাণ্ডের কর্ণধার হয়ে সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জেরা করা। আর তার নিজের দিকে নিজেকে তাকাতে বললে ক্ষেপে শাপ-শাপান্ত করা। কথা হচ্ছে আমরা সে আদর্শ মৌলবাদরহিত মানসিক সাম্যাবস্থা কল্পনায় আনতেই পারি, কিন্তু তার কতটা বাস্তবসম্মত প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি তা অত্যাধুনিক কিম্বা আধুনিকোত্তর সমাজের দিকে ভালো করে তাকালেই বুঝব – কার্যক্ষেত্রে সে বহুদূর এখনও।
আরেক তর্কের কথা আছে। “আমার দুধের সাদা রঙ নিয়ে আপত্তি নেই, দুধের স্বাদ নিয়ে আপত্তি নেই, দুধের গন্ধ নিয়ে আপত্তি নেই, দুধের দাম নিয়েও আপত্তি নেই – কিন্তু দুধ আমার দু'চক্ষের বিষ, দুধ আমি সহ্য করতে পারি না”। অর্থাৎ সে প্রমাণ করতে চাইল যে, সে আদতে পক্ষপাতদুষ্ট নয়, তবে বাক্যাতীত, প্রকাশাতীত এমন কিছু একটা কারণ আছে যা কিনা তার প্রতিপক্ষ বুঝতে পারছে না, সেটাই তার আপত্তির মূল। অর্থাৎ সোনার পাথরবাটি কিম্বা ঘোড়ার ডিম। এক্ষেত্রে তুলসীদাসের একটা কথা খুব সুন্দর লাগে, ‘রামচরিতমানসে’ আছে - প্রবণতা থাকুক, জেদ বা গোঁড়ামি না থাকুক।
তবে যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, বিষন্নতা-বিমর্ষতা। এরা কারাগার। জীবনটা নিটোল, নিখুঁত, সুচারু ভারসাম্যবিশিষ্ট একটা অস্তিত্ব নয়। এর মূল কথাটাই পেলাম No One Writes to the Colonel -এ। একজন বৃদ্ধ কর্ণেল যিনি পনেরো বছর ধরে তার পেনশানের অপেক্ষায় আছেন। ঘরে তার অসুস্থ বৃদ্ধা স্ত্রী। আর আছে একটা মোরগ। যে মোরগটা লড়াকু, যার সাথে তার নিহত যুবক সন্তানের স্মৃতি জড়িয়ে। দারিদ্র্যের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছিয়ে যান তাঁরা। মানুষের বড় দায় তার মান রক্ষার, তার নীতি রক্ষার, তার স্মৃতিকে আঁকড়ে বাঁচার। এগুলো ছাড়া সে আর মানুষ কোথায়? অগত্যা খাদ্যাভাব তাদের পীড়িত, আশঙ্কিত, ক্ষত-বিক্ষত চিত্তকে তুমুল ঝড়ে পড়া জাহাজের মত বিপর্যস্ত করে তোলে। তারা ভাঙতে গিয়েও ভাঙেন না, তারা হার স্বীকার করার চরম সীমানায় পৌঁছিয়েও অবশেষে টাল সামলে নেন। গল্পটা ঘটনার স্রোতে মিলে গিয়ে পাঠককে চেতনার একটা শক্ত-উঁচু পাথরে বসে জীবনটাকে দু'হাতে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে বলে। এই একই গল্প চূড়ান্ত বিষন্নতা আর বিমর্ষতায় লেখা যেত, উপাদানের ঘাটতি হত না। কিন্তু মার্কেজ ঝড়ের উপরে উড়তে পারেন, উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে একটা কাঠের পাটাতনকে বুকে জড়িয়ে প্রতিটা ঢেউকে আলাদা আলাদা করে মূল্যায়ন করতে পারেন। তাই বিমর্ষতার কারাগারে ফেলে রেখে, বা বিষন্নতার দ্বীপে পাঠককে আটকে রেখে তিনি ফিরে যান না। তিনি লড়াইয়ে নামতে বলেন। কারণ মানুষের মধ্যে তার বুদ্ধির পারে আরেকটা বস্তু আছে – তার মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্বের কোনো সংজ্ঞা হয় না, সে মানবিক অভিব্যক্তির একটা জটিল অস্তিত্ব। তার গতি আছে, রূপ নেই। তার স্পর্শ আছে, ব্যাখ্যা নেই। তার আলো আছে, ছায়া নেই। তার বিপরীতে পশুত্বও আছে, আত্মকেন্দ্রিকতাও আছে, কিন্তু তারও ব্যাখ্যা হয় বিবর্তনের দীর্ঘপথের মানচিত্রে। সে ক্রমশঃ ক্ষীয়মাণ হবে সমষ্টির চেতনা থেকে সেই দিকে আমাদের গতি – অগ্রগতি।
দুটো কথা। এক, প্রথমটা অনুরোধ। এই বইটা আমি অবশ্যই পড়ার অনুরোধ জানাব আমার না পড়ে থাকা আর সব বন্ধুদের। মার্কেজের বাকি লেখাগুলো যদি নাও পড়া থাকে তবু এই লেখাটা আমার ওনার সর্বশ্রেষ্ঠ লেখা বলে মনে হল। পরে জানলাম ওনার নিজেরও তাই মত ছিল। মাত্র ৬৮টা পাতা। কিন্তু প্রতিটা লাইন... থাক। পড়ে নেবেন।
দুই, বইটা কলেজস্ট্রিট থেকে আমার এক কনিষ্ঠ বন্ধু আমায় সংগ্রহ করে এনে দেয়। বইটার উপরে লেখা 'Shona bouke Shona bor'. কথা হচ্ছে এর মর্মার্থ হল - সোনা বউকে সোনা বর দ্বারা কৃত উপহার, ২৬শে আগস্ট, ২০১২ -তে, সোনা বউয়ের জন্মদিনে।
প্রশ্ন, এক, সোনা লিখতে Sh-এর ব্যবহার হল কেন, যেখানে দু'জনেই বইটা ইংরাজীতে রস গ্রহণে সক্ষম বলে প্রতীয়মান। তবে তেনারা ইংরাজি মিডিয়ামে পড়ে, “বাংলাটা ঠিক আসে না” গোত্রের?
দুই, বইটা সোনা বউয়ের আঁচল ছেড়ে কলেজস্ট্রিটের দোকানে এলো কি করে? তবে সোনা বউয়ের লেখাটা পছন্দ হয়নি, নাও যদি হয় মার্কেজকে না হয় উপেক্ষাই করা গেল, তা বলে অমন প্রেমের সাক্ষ্যবহনকারী অক্ষরমালাকেই কি বাজারি করতে আছে গা? না হয় প্রথম পাতাটা ছিঁড়েই বাকিটা বেচতিস বাছা আমার! যা হোক, লোকে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না, সে তো বেদেই লেখা আছে। পায় তো তাই মূল্য বোঝে না... এই কথা ভাবতে ভাবতে লেখকের দীর্ঘশ্বাস জ্যৈষ্ঠের ঊষ্ণতার সাথে মিশে ঘরটাকে আরো ঊষ্ণ করে তুলছে। যদি বইয়ের সোনা বউ বা সোনা বরটি'র আমার এই লেখা চোখে পড়ে তবে উপযুক্ত প্রমাণসহ বইটা নিয়ে যেতে পারেন (প্রমাণ কি বলে দেব অতবড় ইয়ে আমি নই, হুম...)। আর সোনা বউ আর বরের যদি ইতিমধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে থাকে (বালাইষাট!), তবে? পরে ভাবব এখন আসি। বইটা কিন্তু পড়ে ফেলবেন প্লিজ।
(পরে আমায় একজন বাংলা অনুবাদটা দিলেন, যথেষ্ট ভালো অনুবাদ। লিংক দিলাম।
https://drive.google.com/…/1ZI77fIDGyFdMQK-OGcgqyDq-o…/view…)