দেখুন, শব্দগুলো তো আগেও শুনেছি, মানে আর কি জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনে আসছি। কিন্তু এমন অসামান্য স্পষ্ট, সুরে উচ্চারণ, সত্যিই আমার মনে পড়ে না আমি শুনেছি। মোটে চারটে অক্ষর, তার মধ্যে কি অসামান্য স্পেসিং, একটা প্রগাঢ় আবেগ! ওইটুকু স্বরক্ষেপণেই! ভাবা যায়! আসলে শিল্পী মানুষ, যা করবেন তার মধ্যেই শিল্পের ছোঁয়া থাকবেই। ঠাকুরঘরে রাখা ন্যাতাকাতাতেই ধুপের গন্ধ লেগে যায়, তা এ তো এতদিনের স্বরসাধনা!
আমার ভাবনা, চিন্তা, শক ওসব কিছুই অতো লাগেনি। মানুষের মাথা তো সব সময় এক রকম থাকে না, তা হতেই পারে। একটা ঘটনা শুনেছিলাম না, সেই একজন অনুকূল ঠাকুরের কাছে এসে অভিযোগের সুরে বলছেন, অমুকের কাছে গেলাম, কি বিশ্রীভাবে কথা বলে আমায় ভাগিয়ে দিলে!
তখন তিনি হেসে বলছেন, ওরে মানুষের মাথা কি আর সব সময় ঠিক থাকে রে? মানুষ কি আর সব সময় রসগোল্লা, সন্দেশ নিয়ে বসে থাকে, যে গেলেই হাতে তুলে দিয়ে দেবে? না হয় দুটো খারাপ কথা বলেইছে, আবার মাথা ঠাণ্ডা হবে যখন সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিসখন।
তো এখানে অবিশ্যি তিনি নাকি বলেছেন তিনি যা করেছেন বেশ করেছেন। তা করুন, ওসব শ্লীল, অশ্লীল শব্দ নিয়ে আমার তেমন কিছু মনে হয়নি। আমার যেটা ভয় লেগেছে শুনে ওই 'মাওড়াহিন্দু' কালচার শব্দটা শুনে।
এইখানটায় আমার ভয় লাগে। আমরা বাঙালিরা যে আলাদা, এইটা নিয়ে যে একটা দারুণ উন্নাসিকতা এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আছে, আমার ওইটেকে খুব ভয় করে। আমাদের অস্কার, গ্র্যামি, নোবেল আছে। নিশ্চয়ই আছে। বাঙালি হিসাবে গর্ব থাকা নিশ্চয় ভালো। কিন্তু সে অন্যকে খাটো করে কেন হবে? সে ছোটো বলেই কি আমার বড় হওয়া সহজ হয়েছে? তাদের সংস্কৃতি গ্রাম্য, রুচিহীন, স্থূল, মাংসল, গোদা, আর আমাদের সুক্ষ্ম, বৌদ্ধিক, অপার্থিব, এই সব ধারণাকে আমার ভয় লাগে। এগুলো মোহ। আর মোহ থেকে যত কমপ্লেক্সিটি, আর সেই কমপ্লেক্সিটি থেকেই যত বিপত্তি।
এক একটা সংস্কৃতি, এক এক জাতের। আদিবাসীদের গানের সঙ্গে বড়েগুলাম আলির তুলনা, বা আমির খাঁ, রবিশঙ্করের তুলনা করা কি যায়? যায় না। এক সংস্কৃতির সঙ্গে আরেক সংস্কৃতির তুলনাটাই বড় ছেলেমানুষী লাগে আমার কাছে। ভারতে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি, সাধারণ মানুষের ভাবনার মধ্যে খুব পার্থক্য চোখে পড়েছে বলে আমার মনে হয়নি। একটা রাজনীতির দলকে হারিয়ে আরেকটা রাজনীতির দল আমাদের রাজ্যে জিতেছে, তার সঙ্গে খুব যে সংস্কৃতির যোগাযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। সত্যিই কি সাধারাণ বাঙালি এতটাই সংস্কৃতিপ্রবণ? এত সুক্ষ্ম বিচার করে ভোট দেন তারা? রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কিন্তু তা বলে না। তবে এত ধর্মপ্রাণ বাঙালি, যার পাড়ায় পাড়ায় অবতার, তারা একটা নাস্তিকতায় বিশ্বাসী দলকে এতদিন ধরে ভোট দিয়ে আসত না। তাও দিয়ে এসেছে, কারণ ওসব ধর্ম, সমাজের সুক্ষ্মবোধের চাইতে যে মানুষটাকে ভরসা করার মত লেগেছে, মানুষ তাকেই চেয়েছে। বিবেকানন্দ বলতেন, তত্ত্বতে কিছু হয় না, চরিত্রই সব করে। রাজনীতিতে চরিত্র মানে তার ভরসার মুখ। এই হল কথা।
আমি জানি না এই 'মাওড়াহিন্দু' ঠিক কি কালচার। এটা কি যাকে গোবলয় বলা হয় সে-ই কালচার? আমাদের বঙ্গের রাজনীতি তথা সমাজের ছবি কি ভীষণ উন্নত? তারা তাদের মত করে ভালো, তাদের মত করে খারাপ। আমরা আমাদের মত করে ভালো, আমাদের মত করে খারাপ। এই তো সত্যিটা।
ছোটোবেলায় এক ধরণের হিন্দী সিনেমা গান বিদ্বেষী জ্ঞানী মানুষ দেখতাম। তাদের ধারণায় বাংলার বাইরে যা কিছুই হয় তা-ই নিকৃষ্ট মানের, বাঙালি মানেই উচ্চমানের শিল্প সাহিত্য। অস্বীকার করার উপায় নেই, এককালে তা ছিল। কিন্তু তা সমাজের কতটুকু অংশকে সেটা ঘিরে ছিল? একটা অত্যন্ত অল্প পরিসরে সে কালচার ছিল। 'ভদ্রলোক' বলতে যা বোঝাতো। কিন্তু আপামর ছবিটা সারা বাকি ভারতের থেকে খুব উন্নত কি কোনোদিন ছিল? মনে হয় না। ওই যে বললাম, এক এক রাজ্য, এক এক ভাবে ভালো, খারাপ হয়। আমার ভালোটার সঙ্গে তোমার খারাপটার তুলনা করে আমি যে আত্মতুষ্টিতে কালাতিপাত করি, আদতে সে গণমোহ ছাড়া কি?
আজ বাংলা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে। অনেক জায়গাতেই আমরা তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না। নইলে যে সব গান আমাদের ভাইরাল হচ্ছে, সে গান শুনেই বোঝা যায়, এতদিনের এত এত উচ্চমানের শিল্প চর্চাও শেষে 'কাঁচাবাদাম', 'টুম্পাসোনা' এর কাছে হার স্বীকার করেছে। উপরে উপরে যে কৃত্রিম রং মেখে নিজেরা হনু সেজে বসেছিলাম, সে রঙ আর নেই। অহংকার, অন্যকে ছোটো করে নিজেকে বড় করে, এখানেই যত সমস্যা। আর আত্মবোধ, নিজেকে নিজের মত করে অনুভব করে। অন্যের সঙ্গে পার্থক্যের হিসাবে নয়, অন্যের সঙ্গে আমার যোগসূত্রটা খুঁজতে চেয়ে। তখন আর এই অশ্লীল শব্দগুলো মনেই জন্মাবে না, জিভ অবধি আসবে কি করে?