সৌরভ ভট্টাচার্য
18 February 2020
জানলার উপর দাঁড়িয়ে থাকা মুরগীটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রমেন। খালি গা, লুঙ্গিটা কোমরের সাথে ঢিলে করে বাঁধা, সামনের মাঠ থেকে 'হু হু' করে গরম বাতাস ঢুকছে, ছাদটা তেঁতে রয়েছে প্রচণ্ড। একটু আগে ব্রাশ করা টুথপেস্টের গন্ধটা নাকে আসছে। দিনে তিনবার ব্রাশ করা অভ্যাস, সকালে, দুপুরে আর রাতে। দুপুরে মাজনটা বেশি নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। নাকি, মুখটা ভালো করে ধোয়া হয়নি... জিভটা দিয়ে দাঁতের পিছনদিকগুলো একবার বুলিয়ে দেখে নিল, না, মাজন তো লেগে নেই।
মুরগীটা এখনও জানলায়। কাদের বাড়ির? চশমাটা বালিশের পাশ থেকে নিয়ে চোখে লাগাল, মুরগী না, মোরগ। মাথাটা নাড়ছে, তার সাথে সাথে লাল ঝুঁটিটাও। এমন প্রাণী মানু্ষে মেরে খায়? এই তো ছাপান্ন হয়ে গেল তার, আজীবন নিরামিষাশী, কই? কি এমন শরীরে ছাপ পড়ল? কিন্তু মোরগটা কার? 'মোরগ' শব্দটা দু'বার মাজন-গন্ধ মুখে উচ্চারণ করল, কানে বাজছে, তার চেয়ে মুরগীই বলি, সেই ভালো। মোরগের মাংস খায়?
ফ্যানের ঘড়ঘড় আওয়াজটা হয়েই যাচ্ছে। কোলের উপর হাতদুটো জড়ো করে, পিঠটা কুঁজো করে, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে মোরগটার দিকে তাকিয়ে রমেন। রমেন্দ্রনাথ মল্লিক, পঞ্চায়েত প্রধান। এক ছেলে, এক মেয়ে। দু'জনেই বিবাহিত। বউ মাঝে মাঝেই এ দল, সে দলের সাথে ঘুরতে যায়। এখন যেমন হরিদ্বার গেছে।
খাটের সামনে একটা টেবিল, তার উপর ডাঁই করা কাগজপত্র, সবই সরকারি কাজের। একটা নীল রঙের সোফা ডানদিক দেওয়াল ঘেষে। বাঁদিকে বাথরুমের দরজা। দেওয়ালে একটা বড় কালীর বাঁধানো ছবি, সিঁদুর দিয়ে দিয়ে যার কাঁচটা ঝাপসা, বাথরুমের দরজার বাঁদিকে একটা জলের ফিল্টার। খাটের পিছন দিকে আরেকটা দরজা অন্য ঘরে যাওয়ার, ঠিক তার উল্টোদিকে বাইরের বারান্দায় যাওয়ার দরজা, বারান্দার সামনে রাস্তা, রাস্তার ওপারে মাঠ।
সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। জুন মাস। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরম। রমেন শরীরের প্রতিটা লোমকূপে ঘামের বিন্দু টের পাচ্ছে। হিসি পাচ্ছে, উঠতে ইচ্ছা করছে না। চুলটা কাটাতে হবে, মাথাটা ঘেমে চাপ হয়ে আছে। মোরগটা এখনও জানলায়, টেবিলের উপর রাখা কাগজের দিকে তাকিয়ে, ঠুকরে দেবে কি? নাগাল পাবে? মাথাটা ঢুকলেও বাদবাকিটা?
রমেন উঠে দাঁড়ালো, লুঙ্গিটা শক্ত করে বেঁধে, খাটের উপর রাখা গামছাটায় কপালটা মুছে, মোটা মোটা পা ফেলে ফেলে নিরানব্বই কিলো শরীরটাকে এনে দরজার ছিটকিনি খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বাঁদিকে জানলাটা, জানলায় বসা মোরগ। কার মোরগ?
রাস্তাটা শুনশান। কে বেরোবে এই গরমে? রাস্তাটা কিছুটা গিয়ে মরীচিকায় মিশে গেছে, হল্কায় তেতে আছে রাস্তাটা। একটুও হাওয়া নেই। ভিতরেই যাবে, পিছন ফিরে দেখে মোরগটা নেই। কোথায় গেল? আকস্মিকতায় চঞ্চলতা বাড়ে। রমেনের হাঁটায় চাঞ্চল্য এল, জানলার কাছে গিয়ে দেখে, কই? নেই তো। বারান্দা থেকে নেমে গরম রাস্তায় নেমেও দেখল, না নেই, পা'টা 'ছ্যাঁৎ' করে উঠল গরমে।
যাই হোক, ঘরে ঢুকে আবার দরজাটা দিয়ে খাটে এসে শুলো। কাজের মেয়েটা আসতে আরো এক ঘন্টা, চা দেবে। বিছানায় শুয়েই ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এল ক্লান্তিতে।
ঘুম ভাঙল এক বিকট আওয়াজে। বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঘড়ি দেখল, পাঁচটা দশ, মেঝেতে সারা টেবিলের রাজ্যের কাগজ ছড়িয়ে, ঝড় এসেছে। কারেন্ট অফ। জানলাটার হাওয়াঠেস নেই, 'ধড়াম ধড়াম' করে পড়ছে, ওই আওয়াজেই ঘুমটা ভাঙল। বিছানা ছেড়ে উঠে তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করতে গিয়ে লুঙ্গিটা কোমর থেকে খুলে মাটিতে পড়ে গেল, আলগাই ছিল যদিও, যাক গে, ঘরে কেউ নেই তো আর। জানলাটা টেনে ছিটকিনি আটকিয়ে আবার খাটে এসে বসল, ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঘুলঘুলি দিয়ে যা একটু আলো আসছে। হঠাৎ শুনলো, কঁকর কঁ... মুরগী... মানে মোরগ? কই....
কঁকর কঁ... কঁক্ক... কঁক্ক....
খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এল, আবছা আলোয় রমেন দেখল মোরগটা মেঝেতে ছড়ানো কাগজের উপর হাঁটছে আর ডাকছে.... হাঁটছে না তো, নাচছে...
তাড়াতাড়ি উঠে যেই দরজাটা খুলেছে, হুড়মুড় করে ধুলোয় ধুলো হয়ে গেল ঘরটা, মোরগটা খাটের পিছনের দরজা দিয়ে ততক্ষণে অন্যঘরে। চোখেমুখে একরাশ ধুলো ঢুকেছে, রাগে বিরক্তিতে 'ধড়াম' করে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনিটা আটকে দৌড়ালো পাশের ঘরের দিকে। এই ঘরটা ভীষণ অন্ধকার, কারণ এই ঘরে কোনো ঘুলঘুলি নেই। সবসময় একটা বোঁটকা গন্ধ। বউ এলে ঘরটা পরিষ্কার করা হয়, তারপর আবার বন্ধ পড়ে থাকে। রমেনের কাছে যখন নানা কাজে মহিলারা আসে তারা এই ঘরটা পেরিয়ে ঠাকুরঘরের পিছনের দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে আরেকটা ছোটো ঘরে গিয়ে বসে। তারপর শোয়। তারপর রমেনের সাথে কাজের কথা বলতে বলতে, রমেনের হাত, জিভ, পুরুষাঙ্গের সাথে সমঝোতা করতে করতে কাজের দিন নির্দিষ্ট করে। শুধু এ গ্রাম কেন, পর পর অন্তত তেরোটা গ্রাম রমেনের হাতের মুঠোয়। রমেনের ভাতের থালা এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্যি কারোর নেই। রমেনের আমগাবান, ধানিজমি, পুকুর, বিল, ইটভাটা, জলের কারখানা --- আরো অনেক অনেক ব্যবসা।
রমেন অন্ধকার ঘরটায় দাঁড়িয়ে। আওয়াজটা এই ঘর থেকেই হচ্ছে। কিন্তু কোথা থেকে? এই ঘরে আসবাবের ছড়াছড়ি, রমেনের বউয়ের কাঠের আর বেতের আসবাবের শখ। একটা বেতের টেবিলে ধাক্কা খেল রমেন, অণ্ডকোষে, 'উফ্', বলে মেঝেতে বসে পড়েই মনে হল মোরগটা পিঠ ঘেষে বেরিয়ে যাচ্ছে, পিছনে ঘুরতে পারল না, এত যন্ত্রণা, লুঙ্গিটা ও ঘরে মেঝেতে পড়ে।
রমেন হাতড়ে হাতড়ে খাটটা খুঁজে পেল, খাটের ধারে বসে পা ঝুলিয়ে, ব্যথাটা কমছে। মোরগটা মনে হচ্ছে ঠাকুরঘরের দিকে গেছে। বাজ পড়ল খুব জোরে একটা। বুকটা 'ধড়াস' করে উঠল রমেনের, কিসের একটা ভয় যেন? মোরগটাকে ভয় লাগছে, যেন এক্ষুণি এসে সে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার পুরুষাঙ্গটা ঠোঁটে কামড়ে, রক্তারক্তি হবে সারাঘর। রমেন সারাজীবন একটা মোরগ না মারলেও মানুষ তো মেরেছে, নিজের হাতে, হুকুমে। রমেন দুটো হাতের চেটো দিয়ে নিজের পুরুষাঙ্গ চেপে বসে পড়ে। গুমোট গরম এই ঘরটায়, দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে রমেন। ঠাকুরঘরের থেকে মোরগটা ডাকছে, কঁকর ক... কঁক্ক... কঁক্ক...
রমেন উঠল। দু'হাতে পুরুষাঙ্গ চেপে ধরে ঠাকুরঘরের দিকে এগোলো। ঠাকুরঘরে সবসময় একটা প্রদীপ জ্বালানো থাকে। এখনও জ্বলছে। ঠাকুরঘরে ঢুকে রমেনের হাতদুটো আপনা থেকেই পুরুষাঙ্গ থেকে সরে গেল, মোরগটা বাঁদিকের বড় লোহার ট্রাঙ্কটার উপর বসে, তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে। ওই ট্রাঙ্কের মধ্যে কত মানুষের ভিটেমাটির দলিল, তার কাছে বন্ধক দেওয়া, কেউ জানে না, এমনকি বউও না, এই ঘরে রমেন ছাড়া কেউ ঢোকে না। কারোর অধিকার নেই। এমনকি রমেন ঠাকুরঘরে আছে জানলে থানার বড়বাবুও অপেক্ষা করে বসার ঘরের নীল সোফায় বসে। প্রদীপের ছায়ায় মোরগের ছায়াটা দেওয়ালে মস্ত হয়ে থিরথির করে কাঁপছে। রমেন এক পা এগোতেই মোরগটা ডানা ঝাপটিয়ে এমন 'কঁ কঁ' করে ঢেকে উঠল যে রমেনের হাত-পা এক নিমেষে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রমেন বুঝল সে হিসি করে ফেলেছে, এতক্ষণ চেপে রাখা ঠিক হয়নি, তার ডায়াবেটিস আছে।
রমেন দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। জিভটা শুকাচ্ছে মনে হচ্ছে, ঘাম হচ্ছে। মোরগটা তার দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে। তার চোখের ভিতর থেকে কি একটা জ্যোতি মনে হচ্ছে যেন রমেনের বুকের ভেতরটা চিরে ফালাফালা করে দিতে চাইছে। রমেন নিজেকে বলল, মনের ভুল... মনের ভুল। এই ভাবতে ভাবতে তার মনের মধ্যে কিছুটা সাহস ফিরে আসতেই সে আরেক পা এগোলো। মোরগটা কিচ্ছু বলল না, সে রমেনের দিকে তাকিয়ে, যেন তার প্রতিটা পদক্ষেপ মেপে নিচ্ছে। ঠাকুরঘরের দরজার খিলটা পাশে দাঁড় করানো। রমেন সেটা আড়চোখে দেখে, মোরগটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হাত বাড়িয়ে মুঠোর মধ্যে নিল, ভালো করে ধরতে পারছে না, মুঠোটা ঘামছে। মোরগটা যেন ডানাটা একটু ফোলালো। আবার একটা বাজ পড়ল কাছেই কোথাও। রমেন এক পা, এক পা করে এগোচ্ছে মোরগটার দিকে। লাঠিটা শক্ত করে ধরে রাখতে চেষ্টা করছে, থাকছে না, পিছলে যাচ্ছে ঘামে, তবু মাথার উপর তুলে নিল, আর দু'পা এগোলেই মোরগটার মাথা দু'ফালা করে দিতে পারে। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল, টাল সামলাতে না পেরে ট্রাঙ্কটার গায়ে মাথাটা লাগল, বুঝল রক্ত বেরোচ্ছে। মোরগটা এক লাফে পাশের ঘরের দিকে চলে গেল। রমেনের চোখে অন্ধকার নামছে, সেই শেষ আলোতে দেখল প্রদীপটা মাটিতে পড়ে গেল, আগুন ধরে গেল পাশে স্তূপ করে রাখা রাধাগোবিন্দের কাপড়ে। রমেনের চোখে অন্ধকার ঘন হচ্ছে, আগুনটা ছড়িয়ে যাচ্ছে, তার দিকে এগিয়ে আসছে, মোরগটা তার পাশের ঘরের থেকে ডেকেই যাচ্ছে --- কঁকর ক... কঁক্ক... কঁক্ক...