Skip to main content
 
ছেলেটা এ বছর উচ্চ-মাধ্যমিক দিতে পারেনি। গুরুতর অসুস্থ হয়ে, যমে-মানুষে লড়াই শেষে মাসখানেক পরে যখন বাড়ি ফিরল তখন পরীক্ষা দোরগোড়ায়। ফলে পরীক্ষা দেওয়া হল না। আমি ওর বাড়িতে যাওয়া শুরু করলাম মাঝে মাঝে। ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতাম, এ বছর পরীক্ষা না দিতে পারলি তো কি হল, সামনের বার দিবি। আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নেব সব। ওর বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম, ওর মা নেই। 
 
বেশ কয়েক মাস কাটল। সব যখন স্বাভাবিক হল, ওকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, তুই আমায় বলিস নি কেন তোর মা নেই। 
        বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালো, বলল ২রা অক্টোবরের কথাটা আমি ভুলতে চাই দাদা। মায়ের পেটে একটা টিউমার হয়েছিল। তার আগের দিন নার্সিং হোমে ভরতি হল, অপারেশন হবে। হলও। পরেরদিন আমি পড়ে এসে শুনি বাবা-কাকা সব নার্সিং হোমে। কাকাও কিছু বলল না। ভাবনা হল। কাকা আমার খুব কাছের। কাকা বিয়ে করেনি তুমি জানো তো। আমি কাকার সাথে বাজারে গেলে লজেন্স কিনে দিত। আমাদের খাটাল তো তুমি দেখেছ। লরি করে বিচুলি এলে আমি কাকার সাথে গুণতে বসতাম। 
        অবশেষে কাকা ফোন করল। বলল, সব ঠিক আছে, মাকে নিয়ে আসছি। 
ছেলেটা থামল। চোখের সাদা অংশটা লাল হতে শুরু করেছে। জানিই তো কি বলবে। বলল, মা-কে যে ভাবে নিয়ে এলো দাদা, আমার মনে হল পুরো পৃথিবীটা উল্টে গেল আমার। 
        ও চুপ করল। আমার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। বললাম, কোন সাল?
বলল, ২০১২, আমি বললাম, আমিও তো মাকে ওই বছরেই... জানুয়ারীতে। 
ও তাকালো। বলল, আমি কাউকে কথাটা বলতে চাই না। বলতে গেলেই ওই ২রা অক্টোবরের সকালটা মনে পড়ে বড্ড কষ্ট হয় দাদা। 
        আমি চুপ করে রইলাম। মনে মনে ভাবছি থাক এ প্রসঙ্গ। কিন্তু ততক্ষণে যে ওর প্রাণের আগল খুলে গেছে। বলল, খুব মনে পড়ে যেন। এই যেমন স্কুলে যাওয়ার আগে বলত না, "আয় বাবা খেয়ে নে, দেরি করিস না"... আমার এখনো মনে পড়ে। 
ওর চোখ ভিজল। আমারও চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। বলল, তোমার মনে আছে দাদা, মাঝে স্টেশানে ঠাণ্ডা জলের জায়গা করেছিল? আমি স্কুল থেকে ফেরার সময় রোজ মায়ের জন্য আমার বোতলে করে ঠাণ্ডা জল নিয়ে যেতাম। মা যে খুশী হত...! এই ছোটো ছোটো কথাগুলো খুব মনে পড়ে।
        ওর চোখ উপচালো। তবু স্থির রইল। মনে পড়ে তো, এই ছোটো ছোটো মুহূর্তগুলোই তো বিঁধে থাকে। এত ছোটো, এত তুচ্ছ মুহূর্ত যে আঙুলে ধরে ছুঁড়ে বাইরে ফেলা যায় না। কাঁটার মত বিঁধে থাকে শুধু। 
        বলল, বন্ধুরা যখন জিজ্ঞাসা করে আজ মা কি রেঁধেছিল... খুব কষ্ট হয় জানো দাদা... কিন্তু বলতে পারি না... কি হবে ওসব বলে... আবার মনে পড়বে...। আর কথাই তো বলা হয় না কারোর সাথে। এক কয়েকজন বন্ধু, আর তুমি। আর কে শুনবে বলো। সবার নিজেরই তো কত অসুবিধা। 
        আমার মনে পড়ল সেই দৈববাণী... “ঘন্টা-দুয়েকের অভিজ্ঞতায় সংসারে সে যেন একেবারে বুড়া হইয়া গিয়াছিল।”
        সংসারে বড় তত্ত্ব কিছু শিখিনি, শেখার আশাও রাখি না। বহু হৃদয়ের সাথে যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছি। সব শব্দ ফুরানো চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছি আদিম ভাষার কোনো অক্ষর নেই, ব্যাকরণ আছে - মর্মযোগ। মর্ম একটাই হয়। তার শিকড়গুলো এর ওর শরীরে ছড়িয়ে থাকে। তাই একের টান অন্যের লাগে, একের যন্ত্রণা অন্যের চোখের জল হয়ে বেরোয়। এই যন্ত্রণা-শূন্যতা-অসহায়তার মধ্যে একটাই আলো প্রাণপণ জ্বলে থাকার চেষ্টায় আছে - মানুষ। ঈশ্বর তার গভীরতম অস্তিত্ব সেই মনের মানুষ। তাকেই ছুঁই পূজার আসনে নয়, চোখ বন্ধ করে কোনো বিশেষ রূপে নয়, সে নিজে এসে ধরা দেয় বলে, আমার তো শুধু কাঙালের মত দু'হাত পেতে থাকা। মাটির কাছাকাছি। যেখানে নিঃশব্দ কান্নারা বীজ হয়ে অপেক্ষায় আছে কোনো নরম মাটির, অঙ্কুরিত হবে বলে আস্থায়। মানুষ ততদিন মানুষ যতদিন না সে কাঁদতে ভুলে যায়। শুদ্ধ হতে হবে কি করে না তো?