মন কোথায় রাখব? স্বস্তি নেই মনে। দু বছর আগে যে জীবনটা মনে হত একঘেয়ে, তেমন কিছু কেন হচ্ছে না। আজ সেই জীবনটার চাইতে কাঙ্ক্ষিত আর কিছু নেই। সেই সাদামাটা জীবনটাই চাই। দরকার নেই কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতার। দরকার নেই নিত্য জীবনের বাইরে কোনো অসাধারণ জীবনের। প্রাণ গলায় এসে ঠেকছে। রাতের ঘুম বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চেনা অচেনা সব মানুষের সঙ্গে যে এত কাছাকাছি রকমের বাঁধা আছি সেটা এত স্পষ্ট করে বুঝতে পারিনি আগে। এত এত মর্মান্তিক ছবি ছাপা হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেগুলোর মুখোমুখি কিভাবে হব? শুধু আতঙ্ক তো নয়। অসহায়তায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। জীবিকার জন্য কাজটুকু করেই হোয়াটস অ্যাপে, মেসেজে, ফোনে বসে পড়ছি চেনা অসুস্থ মানুষজনদের খোঁজ নিতে। আজ কেমন আছেন? কোনো মানুষ বাড়ি ফিরে গেছেন শুনে আনন্দে চোখে জল আসছে। তেমনই কেউ চলে গেছেন শুনে হেরে যাওয়া বিষণ্ণতায় আবার কুঁকড়ে যাচ্ছি।
সমস্যা অনেকরকম জন্মাচ্ছে। রোগের নানা জটিলতা তো আছেই। সেটা মুখ্য। সেই সমস্যাকে ঘিরে আরো সমস্যা তৈরি হচ্ছে। অনেকে বাড়ির কাজের লোক ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। আগে যেমন একটা ঘোষিত লকডাউন ছিল। এখন তো আর তা নয়। ফলে জানি না এই মানুষগুলো সাহায্য কিভাবে পাবেন? এইভাবে একে একে মানুষ কাজ হারাবে। সব মানুষ না। অনেক মানুষ। তার হয়তো পরিসংখ্যান বেরোবে। গবেষণা হবে। কিন্তু সে সব তো বাইরের কথা। একটা পরিবার তো শুধু পরিসংখ্যান না। কয়েকটা জীবন। আর জীবন মানেই জীবিকা আর কয়েকটা প্রাথমিক প্রয়োজন তো আছেই। সেগুলো কিভাবে মিটবে?
আরেকটা সমস্যা হল ছেলেমেয়েগুলোর পড়াশোনা নিয়ে। ন্যায্য কারণেই আবার সব বন্ধ হল। কিন্তু পরীক্ষা হবে কিনা, হলে কিভাবে হবে, সে নিয়ে কোনো কথা আমাদের রাজ্যের বোর্ড এখনও জানালো না। ওদিকে মাস গড়িয়ে যাচ্ছে। এরা কবে পরীক্ষা দেবে, কবে পরের ক্লাসে উঠবে, তার পড়াশোনা শুরু হবে? ওদিকে কেন্দ্রের দুটো বোর্ড যেমন পরীক্ষা হবে না ঘোষণা করে ক্লাস ইলেভেন শুরু করে দিয়েছে, আমাদের রাজ্যের বোর্ডের ছেলেমেয়েরা এখনও সংশয়ে ঝুলে আছে। এভাবে হয় নাকি? ওদের এই দিশাহীন অবস্থাটা ওদের পক্ষে এই স্কুলহীন জীবনে তো আরো বড় সমস্যা তৈরি করছে। কেউ ভীষণ গাছাড়া ভাবে চলে যাচ্ছে। কেউ দুশ্চিন্তায় স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ হারাচ্ছে। এগুলো কি এই বয়সে ঠিক? এতটা মানসিক চাপে রাখার তো কোনো মানে হয় না ওদের। যেখানে মূল কথাটা হল একটা অব্যবস্থা।
আসলে অব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলাটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে যেন। আজকেই পড়লাম দক্ষিণ ভারতে কেরল আর তামিলনাড়ু কিভাবে সামাল দিয়ে চলেছে পরিস্থিতি যেখানে উত্তর ভারতে এমন টালমাল অবস্থা। খবরের বক্তব্য অনুযায়ী ওরা গেল বছরের থেকে শিক্ষা নিয়েছে। তৎপর হয়ে অনেক ব্যবস্থা আগে থেকেই করে ফেলেছে। আমাদের তবে কেন হল না? জানি না। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে দক্ষিণ ভারতের মনোভাব অনেকটা ইতিবাচক। আমাদের মধ্যে নেতিবাচক ভাবটা হয় তো বেশি। আমরা সমস্যা হলে দেখা যাবে - এই দর্শনে বিশ্বাসী। আর ওদের সমস্যা জন্মাবার আগে দেখে নেওয়ার উদ্যোগটা বেশি।
এ সব তো টুকরো টুকরো সমস্যা। এর সঙ্গে তো আছেই কাছের মানুষদের থেকে দূরত্ব রাখার কষ্ট। এখন এই “ছুঁয়ো ছুঁয়ো না বঁধু ওইখানে থাকো” করে কি আর দিন কাটে? মুকুরে নিজের মুখ দেখে কি আর বেলা যায়? তবু তাই যাওয়াতে হচ্ছে। নেটফ্লিক্স, বই সব আছে। কিন্তু তারা কি শ্বাস নেয়? তারা কি আর ডাকলে উত্তর দেয়? তাদের গা কি আর মানুষের মত উষ্ণ? তারা কি চোখের উপর চোখ রাখে? তারা কি স্পর্শ করে? মানুষের স্পর্শ ছাড়া মানুষ বাঁচে? সেদিন পড়লাম কোথাও একটা, শঙ্খ ঘোষ ওনার কোনো আইসোলেশানে থাকা প্রবাসী আত্মীয়কে বলছেন, “গান শোনো। উদ্বিগ্ন হয়ো না।” এ কথাটা মনে ধরল। ভাবলুম আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ যদি আইসোলেশানে থাকতেন তবে কি করতেন? হয় তো খানিক গপ্পো লিখতেন, যেমন করে ছোটোগল্পগুলো জন্মেছিল। কিন্তু সে বেশিদিন ওর নিশ্চয় ভালো লাগত না। তবে কি করতেন? গান গাইতেন। গান বাঁধতেন। নিজেই তো বলছেন না গানে?
দিন পরে যায় দিন, বসি পথপাশে
গান পরে গাই গান বসন্তবাতাসে॥
ফুরাতে চায় না বেলা, তাই সুর গেঁথে খেলা--
রাগিণীর মরীচিকা স্বপ্নের আভাসে॥
দিন পরে যায় দিন, নাই তব দেখা।
গান পরে গাই গান, রই বসে একা।
মানে উনি গানেই হয় তো ডুবে থাকতেন। কিন্তু তা নয় জানেন। একবার সেই কলকাতায় যখন প্লেগ হল নিজের পরিবারকে শান্তিনিকেতনে রেখে কলকাতায় চলে এলেন না? সেই তহবিল গড়ে টড়ে সাহায্যের কাজে লেগে পড়লেন। হয় তো উনি দুটোই করতেন। এই যে দায়িত্ববোধহীন অলম্বুষ রাজনীতির লোকেদের আচ্ছা করে বকাঝকা করতেন। আর একান্তে বসে গান বাঁধতেন। যন্ত্রণার গান। এত মানুষের এত অসহায়তা কারোর বুকে আজ তেমন করে বাজছে না বলেই না এমন ঢিমে তেতালায় চলছে সব! সব কি আর খাতায় কলমে হয়, না বইতে লেখা থাকে। মানুষের তাগিদটা জন্মায় যখন তার প্রাণ কেঁদে ওঠে। রাস্তা বানিয়ে নেয় তখনই। কিন্তু কেউ খবর বেচে খাচ্ছে, কেউ খবর তৈরি করে মুনাফা দেখছে। এর মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু লোক যারা সংগঠিত নয়, একত্রিত নয় তারা চীৎকার করে বলেই যাচ্ছে, সামলাও, সামলাও, এত গাছাড়া দিও না।
তবু আশা। আমাদের সবাইকে নিয়ে এক মহামানব তো আছেনই। নইলে একের অসহায়তা অন্যের চোখের জল হয়ে দেখা দেয় কিসের জোরে? সেই মহামানবের প্রাণের তরঙ্গেই তো? তিনি এর থেকে বেরোবার রাস্তা নিশ্চয়ই করবেন? আমাদের একসাথে দাঁড়ানো লড়াইয়ে। কারণ হাতের উপর হাত রাখা সোজা না হলেও, বেশিদিন হাত ছেড়ে থাকাটাও সোজা কাজ নয় মোটেই।