সৌরভ ভট্টাচার্য
22 May 2020
- ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব কি করে? আমি যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না।
- মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা? তাও কি করা সম্ভব নয়?
- কার কাছে প্রার্থনা? কোনো মঙ্গলময়ের উপর যে আমার আর বিশ্বাস নেই।
- মঙ্গলে? তাতেও কি বিশ্বাস নেই?
- জানি না, হয় তো নেই।
- কিন্তু সে তো সাময়িক, এই প্রবল দুর্যোগে, সংকটের মধ্যে পড়ে এমন মনে হচ্ছে, কিন্তু তবু কি সব কিছু ভালো হোক এ চাওয়াটা নেই বুকে? কণামাত্র হলেও?
- আছে।
- ওইটুকুই কি সম্বল নয়, শুধুই ‘নেই নেই’ করে কাটালে কিছু কি হয়?
- কিন্তু প্রার্থনা মানে তো চাওয়া? নয় কি?
- খুব নীচু অর্থে। যেমন অনেকের কাছে পড়াশোনা মানে স্কুলে যাওয়া, মাষ্টারের কাছে যাওয়া, পরীক্ষা দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু সত্যি করে বলো, এইগুলোই কি পড়াশোনা? না শুধু মাত্র আনুষঙ্গিক? সেরকম ঈশ্বরও আনুষঙ্গিক, যদি মঙ্গলের প্রতি আস্থা না থাকে।
- সে কি রকম?
- আচ্ছা ধরো, খৃষ্ট, নানক, কবীর, বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ – এরা কি কেউ বলছেন জীবন মাখনের মত নরম রাস্তায় হাঁটা? এদের নিজেদের জীবন কি খুব মসৃণ ছিল?
- না তা তো নয়।
- কিন্তু এদের জীবনের মূল সুরটা এক – মঙ্গল। কিসে মঙ্গল? সেকি স্বার্থপরতায়? তা তো নয়।
- কিন্তু আমরা তো সাধারণ মানুষ!
- বুদ্ধ কি আরো দশজন বুদ্ধের সাথে হেঁটেছেন? খ্রীষ্ট কি আরো কুড়িজন খ্রীষ্টের সাথে? না রামকৃষ্ণ আরো তিরিশজন রামকৃষ্ণের সাথে? তাঁরা যা বলেছেন তা তো সবই সাধারণ মানুষের জন্যেই। তাঁরা সারাটা জীবন যা অত্যাচার সহ্য করেছেন সে তো সাধারণ মানুষের জন্যেই, নাকি দল-মত-মঠ-মিশন প্রতিষ্ঠা করবেন বলে?
- আমাদের তবে উপায় কি?
- চিরকালই যা উপায় ছিল, নাস্তিক হও, আস্তিক হও, যে ধর্মেই বিশ্বাসী হও – মঙ্গলের প্রতি আস্থা। সংশয় আসবে না তা নয়, তখন ওই চরিত্রগুলোর সামনে দাঁড়ানোর সময়, প্রতি মুহূর্তে তাদের কি কঠিন জীবন সংগ্রাম সে কথা মনে করার সময়। কারণ একটা সার্বিক মঙ্গলের ধারণাকে দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে বাস্তবায়িত করে তোলার জন্য যে লড়াই, সে তো বাইরের লড়াই না, সে মানুষের হৃদয়ের অন্ধকারের সাথে লড়াই। সে ভীষণ কঠিন। মানুষের জগতে সব চাইতে কঠিন বস্তু – “আমিই সব, আমার জন্যেই সব” এই ধারণা। এর সাথে লড়াই কি চাট্টিখানি কথা? রামকৃষ্ণের একটা গল্প আছে। এক মাতাল দূর্গা ঠাকুর দেখতে দেখতে বলছে, তা মা যতই সাজোগোজো, রাণী হয়ে থাকো, কদিন পরে ঠিক টান মেরে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে...
- কিন্তু আমি নিজে যদি ভালো না থাকি, কে ভালো থাকল না থাকল তাতে আমার কি এসে গেল?
- এই কথাটাই অমঙ্গলের কথা। কথাটাকে যদি অন্যভাবে ভাবা যায় - যদি সবার ভালো থাকার একটা ব্যবস্থা করা যায়, তবে আমার ভালো থাকাটাও তার মধ্যেই ঢুকে যায়, এ আরো ভালো ভাবনা নয় কি? আর যদি অন্যে ভালো আছে শুনে আমার ঈর্ষা হয়, শান্তি না হয়, তবে তো বুঝতে হবে আমার শিক্ষাদীক্ষা শুধু আমার হৃদয় আর মস্তিষ্ক বাদ দিয়ে আমার পোশাক-আশাক ইত্যাদি বাইরের জীবনটুকুই নিয়ে আছে। তখন তো আমি না আস্তিক, না নাস্তিক – আমি অমানুষ। অমানুষের ভাবনায় সমাজ চলে না। সমাজ চলে মানুষকে নিয়ে। সামাজিক কর্তব্যবোধে। সমাজ মানে শুধু ‘আমি’ না। মহানামব্রত ব্রহ্মচারী বলতেন, ধর্ম পরে হবে, আগে তো বাপু gentleman হও। অর্থাৎ, একজন মার্জিত ভদ্রসভ্য মানুষ হও। তারপর বাকিটা আপনিই জন্মাবে। শেষে একজন নাস্তিকের কথা দিয়েই শেষ করি, তিনি বলতেন, মানুষের সম্পূর্ণ উন্মাদ হওয়ার আগের লক্ষণগুলোর একটা হল, নিজেকে এবং নিজের কাজকে জগতে অপরিহার্য মনে করা। কথাটা বলতেন, রাসেল সাহেব।