সৌরভ ভট্টাচার্য
7 July 2020
দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। সমাজে যেরকম পোশাকের মহিলাদের মেয়েছেলে ডাকা হয় দু'বার না ভেবেই, সেরকম একজন, মধ্যবয়স্ক মহিলা মাঠে বসল। পিছনে গঙ্গা। তীর জুড়ে ইটভাটা। বেশ বড়। এই দিকটায় কেউ আসে না।
শৌচ শেষ করে গঙ্গার দিকে এগিয়ে গেল। গঙ্গায় নেমে বুক জলে দাঁড়িয়ে। সমস্ত শরীরটা নিয়ে ডুবে গেলেই যেতে পারে, এমন তুচ্ছতা সর্বাঙ্গে। আকাশে ঘরে ফেরা পাখির দল। সূর্য ডুবে গেছে। আলো সবটা ফিরে যায়নি এখনও। যাবে সূর্যের পিছনে পিছনে আরেকটু পরে। বিশাল বট গাছটা থেকে পাখিদের ঘরে ফেরার উল্লাসের শব্দ।
একজন যুবক হাড়ি নিয়ে চিংড়ির বাচ্চা খুঁজছে গঙ্গায় বুক জলে ভেসে ভেসে। পাড় ঘেষে ঘেষে। রোজ খোঁজে। মহিলা তাকে দেখল ঘাড় ঘুরিয়ে। না কিছু বলল, না হাসল, না কোনো রকম চেষ্টা দেখালো নিজের বুকের থেকে খসে পড়া আঁচলটা আবার তুলে নেওয়ার। ওসব অভ্যাস ছেড়ে গেছে। বুকের উপর আঁচল রাখার নিজের ইচ্ছাটুকুর অধিকার হারালো যেদিন, তার স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর... সেদিন তার কোলে বাচ্চা, পেটে বাচ্চা। সেদিনই ডুবল না, আর আজ ডুবছে!
মাথা ডুবিয়ে স্নান করল। ভেজা কাপড়ে পাড়ে উঠে এল। ঘটি ভরা গঙ্গাজল। একটা পোকা যেন, ছটফট করছে। হতে পারে। চোখ ঝাপসা, ভালো দেখা যায় না।
নিজের ঘরে এসে ভিজে কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পরল। গিঁটে গিঁটে ভীষণ ব্যথা। আজন্ম ব্যথা। দরজার সামনে একটা শীর্ণ তুলসীগাছে ঘটির জলটা ঢেলে দিল। সত্যিই একটা পোকা ছিল। গাছটা বেয়ে উঠতে চেষ্টা করল কয়েকবার। পড়ে গেল। ঘরে এসে, খাটের তলা থেকে মদের শিশি বার করে গলায় ঢালল। তারপর মনে পড়ে যেতে শুরু করল সব। ছোটোবেলা থেকে তার শরীর মন নিয়ে পুরুষদের ছিনিমিনি খেলার গল্প, বরের গল্প, এই ইটভাটার শকুনদের গল্প, দুটো ছেলেরই তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার গল্প, এমনকি বলে পর্যন্ত যায়নি, "মা আসছি", সেকি আটকাতো! গলা ছেড়ে খিস্তি করে এই সময়। গলায় কফ জড়িয়ে যায় গোঙানিতে। বমি হয়ে যায় মাঝে মাঝে। রাতে খায় না। ঘুমিয়ে পড়ে। পরেরদিন দেখে, সকাল হয়েছে, মরেনি।
সকালে উঠে ইটভাটায় গেল। এটা ওটা সারতে সারতে দুপুর গড়ালো। ভাত নিয়ে বসেছে ঘরে, এমন সময় প্রকাশ এসে বলল, এই মায়ি, তোকে মালিক ডাকছে...
তোর ছেলের চিঠি এসেছে.... মুঙ্গের থেকে... একটা দোকান দিয়েছে... তোকে পাঁচশো টাকা পাঠিয়েছে.... আর বলেছে কাউকে দিয়ে চিঠি লেখাতে, তুই বেঁচে আছিস না মরে গেছিস জানার জন্য.... নইলে টাকাটা ফেরত পাঠিয়ে দিতে বলেছে..... আর বেঁচে থাকলে মাসে মাসে টাকা পাঠাবে....
চোখ এতবড় করে কবে শেষ তাকিয়েছে মনে নেই জানকির। চোখটা চিকচিক করল। জল এল না। বুকটা ধড়াস ধড়াস করল। থেমে গেল না। পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল.... যেতে বলেনি!...
মালিক চীৎকার করে বলল,.... আরে টাকাটা নিয়ে যা.....
জানকি শুনল না। দাঁড়াল না।
মাখা ভাত কুকুরকে খাওয়ালো। সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকল। বহুযুগ পর সন্ধ্যেবেলা ইটভাটা শান্ত। না গালাগালি, না গোঙানি।
পরেরদিন থেকে জানকিকে আর দেখা যায়নি ইটভাটায়। গঙ্গার ধারে এ-সে অনেকবার খুঁজেছে। বটগাছটার ডালে ভালো করে তাকিয়ে দেখেছে। অত সরু মানুষ, এত ঘন ডালপালায় ঝুলে থাকলেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু সে মরেনি। মুঙ্গেরেও যায়নি। হারিয়ে গেছে। আর মানি অর্ডারও আসেনি।