Skip to main content
 
 
 
আমি জানি, তোমার বৃত্তের বাইরে তুমি অনেকখানি। যেখানে তুমি একা। সংসারে তুমি ভালোবাসার মানুষ হতে হতে দরকারের মানুষ হয়ে দাঁড়ালে। তোমার কর্তব্য বাড়ল। দায়িত্ব বাড়ল। তোমায় না হলে সংসারে এক মুহূর্তে কারো চলে না। তুমি অসুস্থ হয়ে শুয়ে পড়লে, সবাই চোখে অন্ধকার দেখে। কদিন বাড়ি ছেড়ে বাইরে থাকলে সংসার যেন স্তব্ধ।
       এ সব গৌরবের কথা। এ সব ঈর্ষার কথা। লোকের কাছে। আসলে তুমি জানো, সংসারে তোমার দরকারি তুমির কাছে তোমার আসল তুমিটা চাপা পড়ে যাচ্ছে রোজ একটু একটু করে। তুমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছ। নিতান্ত সাদামাটা, অদরকারি 'তুমি'টার জন্য পরিসর ক্রমে কমে আসছে। তুমি আরো বেশি করে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তুলছ। তুমি আরো বেশি করে নিজেকে আবশ্যক করে তুলছ। যাতে তোমার ওই ছোটোবেলার আমিটার গলার আওয়াজ তোমার কানে এসে না পৌঁছায়। যাতে অকারণ, এমনি এমনিই ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় বাঁচা কাঙাল মানুষটার ক্ষুধার্ত দৃষ্টি তোমার কাজের পথ আগলে না দাঁড়ায়। তুমি পালিয়ে যাচ্ছ। তুমি নিজেকে ভুলিয়ে রাখছ অনেক অনেক মূল্যবান সম্পদের আড়ালে তোমার চিরকালের তোমার অমূল্য আমিটাকে। তুমি ক্লান্ত হচ্ছ। তুমি ক্ষয়ে যাচ্ছ। তুমি লড়াইয়ে নেমেছ তোমার সমাজ, তোমার দায়িত্ব, তোমার কর্তব্য ইত্যাদি নানা রথী-মহারথীদের বিরুদ্ধে নিজের হৃদয়টাকে নিয়ে - যে অবুঝ, যে অবাধ্য, যে দামাল, যে জীবন্ত।
       তোমার এখন যখন তখন মন খারাপ। সবাই জানে, ওর এরকম হয়, আবার ঠিক হয়ে যাবে। হাজার হোক মানুষ তো, মানুষের মন তো। সবাই অপেক্ষা করে তোমার সেরে ওঠার, তোমার ভালো হয়ে ওঠার, তোমার চাকায় সংসারের গাড়িটাকে আবার ছুটিয়ে দেওয়ার। সবার অপেক্ষা। শুধু তোমার জন্যে তোমার ভিতরে যে অপেক্ষায় আছে, তুমি তার ডাকে কবে সাড়া দেবে?
       শুধু তুমি নও। আমাদের বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে এমন তুমি ঘরে ঘরে দেখেছি। তাই চোখের কোল ভারি দেখে জিজ্ঞাসা করি না, কি হয়েছে? জানি হয় তো। চুপ করে থাকি। মন খারাপ বড় ছোঁয়াচে। ছুঁয়ে যায়। একা হই। তোমার একাকীত্বের পাশে দাঁড়াই। একাই। কথা নেই কোনো। অনুভবের ভাষা চোখের মণির আশেপাশে আনমনে ঘুরে বেড়ায়। জিভ তো অনুভবের গায়ের চাদর। আড়াল করে দেয় অন্য কথায়।
       তবু তুমি একা হোয়ো। কিছুক্ষণের জন্য হোয়ো। না হয় বিকল মনেই হোয়ো। তবু নিজের মানটুকু থাক। এ বিশ্বসংসারে নানা পরিচয়ের মধ্যে তোমার যে একটা নিজস্ব পরিচয় আছে, সে সেই মন খারাপের সময়টুকুতেই না হয় নিজের অস্তিত্বটুকু বুঝুক। তোমার যে পরিচয় আর কারোর পরিচয়ের সাথে যুক্ত নয়, যেখানে তুমি তুমিই, শুধুই তুমি, সেখানে তোমার একমাত্র বন্ধু তুমি নিজেই। সেই অন্তরতম বন্ধুকে কেউ কেউ ঈশ্বর বলে, কেউ বলে অন্তর্যামী। আমি এত কথা বুঝি না। আমি এইটুকু বুঝি, অনেক কিছু হারিয়ে বুঝি, সবাই সরে দাঁড়ালেও আমার মধ্যে কোনো এক গভীর আমি আছে, যে হারায় না। যে পরম আত্মীয়ের মত বুকে জড়িয়ে ধরে। তার সাথে আমার নিত্য সম্পর্ক। কেউ কেড়ে নিতে পারে না। কেউ না। মনে রেখো।