মনে রেখো, কিছু কিছু বাড়িতে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ থাকে। তাদের আগলে রাখে, প্রাণপণে আগলে রাখে আরেকজন মানুষ, বা কয়েকজন মানুষ। যে বা যারা প্রতিদিন মৃত্যুকে বলে, আরো একটু পরে... আর ক'টা দিন... থাক না..
সকালে উঠে নাকের কাছে হাত রেখে দেখে, শ্বাসের গতি কেমন। নাড়ি মাপার, রক্তে চিনি মাপার যন্ত্র এনে দেখে নিতে হয় খাদের থেকে কতটা দূরে সে আর!
যেমন বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে, চারদিকে কোলবালিশ দিয়ে ঘিরেও শান্তি নেই, যদি খাট থেকে পড়ে যায়, তেমনই নিভে আসা জীবনপ্রদীপকে দু হাতে আগলানো, যেন অন্ধকারে তলিয়ে না যায়।
মাথার বালিশটা উঁচু করে দিয়ে, বুকের কাছে মাথা এনে বলতে হয়, আজ দুর্গাপুজো... আজ ষষ্ঠী... তোমায় নতুন কাপড় পরাবো, তুমি না বুঝলেও পরাবো। তোমার সমস্ত অতীতকে মনে করাব নিঃশব্দে। তোমায় ছুঁয়ে থাকব। তুমি যেয়ো না শুধু। থাকো। আরো কদিন থাকো। আমি কোথাও যাইনি দেখো, কোনো ভিড়ে মিশে হারিয়ে যাইনি। জানি তুমি যাবে অবশেষে। আমি আটকাতে পারব না। তোমায় শেষ সিঁড়ি অবধি এগিয়ে দিয়েই আসব। আমার আজ আর কিসের উৎসব!
সবাই চায় তার প্রিয় মানুষটা আরো কদিন আলো-বাতাস মেখে বাঁচুক। রাখুক মাটিতে পা। কথায় প্রাণ বাঁধুক। সবাই চায়।
উৎসবের আলো, গান জানলা দিয়ে আসে। কখনও জানলা বন্ধ করে, কখনও খোলে। কখনও বিরক্ত হয়, কখনও হয় উদাস। কোনোদিন ভাত পড়ে রইল থালা জুড়ে, কোনোদিন পুষ্টি পানীয় ঠেকালো না ঠোঁটে। সব হিসাব রাখতে হয়। চিকিৎসক জবাব দেওয়ার পরেও, আর কিছু করার নেই।
মনে রেখো, কিছু মানুষ এই মুহূর্তেও সব চিকিৎসার বাইরে কিছু মানুষকে নিয়ে বাঁচছে। প্রার্থনার ক্লান্তিতে, অবসন্ন হাতে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে, তার মাথার কাছে বসে থাকছে। বাইরে বাজছে ঢাক। বাইরে বাজছে কাঁসর, শাঁখ। সে ঘরে বসে হাতদুটো জড়ো করে কপালে ঠেকাচ্ছে। নির্বাক চিত্ত। কারোর অপেক্ষা নেই তার। তার জন্যেও যেন অপেক্ষা নেই কারো। সে বাইরে যায় না। তার সারাটাদিন লড়াই, যমে মানুষে। সে ভাবছে, পরের পুজোয় থাকবে তুমি? থাকবে, বলো না... থাকবে? এমন মানুষও আছে। আমি জানি আছে। তুমিও জানো আছে।
মনে রেখো, এই সব কথা, এই সময়েও মনে রেখো, তোমার উৎসব আরো গভীর হবে, অর্থবহ হবে। উৎসব মানে কি শুধুই হুল্লোড়, শুধুই হুজুগ! প্রাণের আগল খুললে অনেকের না বলা ব্যথা সহজে আসন পেতে বসে প্রাণে। বলে একটু জল দাও, একটু দাও শুশ্রূষা। আমি ক্লান্ত। আমিও সমাজ। আমিও আছি। আমিও ছিলাম।
নিভু নিভু প্রাণ সামলিয়ে যে মানুষেরা, তাদের ঘরে তেমন আলো না জ্বলুক, হাসির ফোয়ারা না ফুটুক, নতুন জামা, নতুন রান্নার আভাস না আসুক। তারাও আছে, মনে রেখো।
যে মানুষটা বলছে, এবার গেলেই বাঁচি, সে-ও আসলে যেতে চায় না... জানোই তো...
আর যে মানুষটা বলছে, আর পারছি না... সে-ও আসলে বলতে চাইছে হাতটা ধরো... আশ্বাস দাও... যেন আরো ক'টা দিন পারি.... বোঝোই তো...
এত অন্ধকারে এরাই তো আলো। যারা নিভু নিভু প্রাণের দু’পাশে রাখে অতন্দ্র দুটো হাতের পাহারা.... অবশেষে বাতাসের কাছে সবটুকু হারাবে জেনেও...