এক মহিলা শ্রীরামকৃষ্ণর পাশে বসে। সদ্য আট বছরের সন্তানকে হারানো মা। কোল খালি। বুক খালি। গোটা সংসার খালি হয়ে গেছে। সামনে শুয়ে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। গলায় ক্যান্সার। কয়েকটা হাড়। চোখ দুটো কোটরে। ঢোক গিললে গলার হাড়টা উঠছে নামছে, দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ওই গলাতেই মারণরোগ। সদ্য সন্তানহারা মা তাকিয়ে দেখছে। কী নিষ্ঠুর তুমি ঈশ্বর! ওই কণ্ঠেই এত নামগান তোমার… আর ওই কণ্ঠেই এমন মারণরোগ! তবু কোটরে ঢোকা দুটো চোখে কী স্নেহ! কী উজ্জ্বলতা!
শূন্য মন নিয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে শীতল বাতাস লাগছে প্রাণে।
মহিলা নীচে নামছেন। সিঁড়ি ধরে ধরে। কাশীপুরের বাগানবাড়ি। নীচের ঘরে মা আছেন। মহিলা মায়ের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালেন।
“মা আসব?”
এসো।
পরমশান্তি শরীর ধারণ করে বসে আছেন। ছোটোঘর। একপাশে বসলেন মহিলা। মা তাকালেন। সেই এক স্নেহ। এক শান্তি। তবে এ দুটো উজ্জ্বলতায় মোড়া স্নিগ্ধতা। কিন্তু এ সব তো মিথ্যা! আমার তো সব গেছে মা! সব! আমার কোল খালি করে চলে গেল সে! সব গেল! সব!
সব কান্নাটা ধারণ করলেন মা। শ্রী শ্রীমায়ের চোখের কোণে জল। হাতটা সন্তানহারা মায়ের মাথার উপর রাখা। মাথাটা মেঝেতে লুটিয়ে। নীড় শূন্য। শোক। শোক। শোক। গোটা বিশ্ব যুগযুগান্ত ধরে পুড়ে যাচ্ছে শোকে।
শোকাতুরা উঠে বসলেন। শ্রীমা তাকিয়ে আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ উপরে। মারণরোগে। চলে যাচ্ছেন। চারদিকে ভক্তরা যাতায়াত করছেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন কেউ কেউ। বিমর্ষ চোখমুখ। ঠাকুর থাকবেন না। সব অন্ধকার হয়ে যাবে। সব চলে যাবে।
সন্তানহারা মহিলার স্বামী বসে আছেন একটু দূরে। বাইরে। সামনে পুকুর। সেই জলে স্থির চোখে তাকিয়ে কী দেখছেন। পুকুরে বর্ষার আকাশের ছায়া পড়েছে। কালো মেঘের ছায়া। সজল হাওয়া বইছে। সারা কাশীপুর বাড়ি চন্দনের গন্ধে ম ম করছে। চন্দনের গন্ধ? নাকি অন্য কিছুর? বড় শুদ্ধ স্নিগ্ধ গন্ধটা।
উপরের ঘর থেকে কীর্তন ভেসে আসছে। মহাপ্রভু বেরিয়েছেন নগর সঙ্কীর্তনে। হরিনামে ভেসে যাচ্ছে আকাশ বাতাস। শ্রীমা ধ্যানমগ্না নিজের ঘরে বসে। ঠাকুর সমাধিস্থ। কীর্তনের সুরের ডাকে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। শোকদগ্ধ মা কাশীপুরের বাগানবাড়ির এক কোণে গিয়ে বুকের সবটুকু শক্তি দিয়ে নিংড়ে কেঁদে উঠলেন… তুই কোথায় গেলি রে… আমি তো আর পারছি না… শোক চলে গেলে সন্তানের শেষ অনুভবও চলে যাবে….. শেষ স্মৃতিও চলে যাবে…..
=======
শ্রীমা খাবার হাতে উঠছেন সিঁড়ি দিয়ে। পিছনে পিছনে আলো হাতে উঠছেন সে রমণী। ঠাকুর খেতে চেষ্টা করছেন। শ্রীমা স্থির চোখে তাকিয়ে ঠাকুরের দিকে। ঘরে কেউ নেই আর। সজল বাতাসে দীপের আলোটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঠাকুরের খেতে কষ্ট হচ্ছে। গিলতে কষ্ট হচ্ছে। তবু কথা বলছেন,
তোমার কী রাঁধতে ভালো লাগে…. তোমার বাড়িতে আর কে কে আছে? মেয়ে আছে? বাহ! তাকেও এনো। এখানে এনো… কেমন… একা থেকো না…. শোকে একা থাকতে নেই….. তার নাম কোরো…. যে নাম করতে ইচ্ছা…. সমস্ত শোক নিয়ে ডেকো…. বোলো, হে ঈশ্বর তুমি কেমন জানি না… আমাকে বুঝিয়ে দাও…. তিনি আছেন…. তিনি নিষ্ঠুর?.... তিনিই সব…. সব বুঝে যাবে…. অল্প আলোয় শুধু এই ঘরের ভিতরটুকু দেখা যায়… অনেক আলোয় ঘর-বার দুটোই আলোকিত হয়ে যায়….. ধীরে ধীরে সব হবে… শ্রীমাকে দেখিয়ে বললেন, ওর কাছে থাকো কদিন….. শোক বড় বিষম জিনিস….. ওর কাছে থেকো শান্ত হবে….
ঠাকুরের খাওয়ার এঁটো মহিলা নিজের হাতে মুছলেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বুকের ভিতর বৃষ্টি নামছে। একবার তাকালেন ঠাকুরের দিকে। কী কষ্ট মানুষটার। তাও স্থির স্নেহের চোখে তাকিয়ে তার দিকে। ঠোঁটের কোণায় ভুবনভোলানো হাসি। যে হাসিতে ভর করে ভুবনমোহিনী মায়া তরে যাওয়া যায়…..
শ্রীমা মেয়ের নাম রেখেছেন মানময়ী। ঠাকুরের শরীর ছাই হয়ে বাদল বাতাসে মিশে গেছে। কিন্তু সে হাসি, সে কথা ফুরায়নি…. ফুরাবেও না। সংসারে মন বসছে অল্প অল্প। শোকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাগল পাগল লাগে। সত্যিই তো পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। শোকের দিকে না, ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে থাকব। শোকের এক সম্মোহনী শক্তি আছে। যে নেই তার দিকে এমন সত্যি করে ডাকে, যে আছে, যারা আছে তাদের ভুলিয়ে দেয়। কী অমোঘ ডাক! কিন্তু সাড়া দেব না আর! আর না। শোক ভালোবাসার রাস্তা আটকায়। বলে ও মোহ! আবার জড়াবে! শোক ছদ্মবৈরাগ্যের বেশে আসে…. বলে সব মিথ্যা…. আমি সত্য… গোটা বিশ্বজুড়ে দেখ শুধু হাহাকার… শুধু মৃত্যু…. আমারই তাণ্ডব…. জীবন মিথ্যা…. কুহক…..
শ্রীরামকৃষ্ণ শেখালেন আনন্দ সত্য…. চেতনা সত্য…. শোক হয়… ভ্রম হয়… মনের স্বভাবই ভ্রমের ঘোরে ঘোরা..যতক্ষণ মন আছে ততক্ষণ শোক.. দ্বন্দ্ব.. সংশয় সব আছে…… কিন্তু মন ধোপা ঘরের কাপড়ও বটে… যে রঙে ছুপাবে সেই রঙ ধরবে… মন আমাকে দাও…. মনের বাজে খরচ কোরো না…. আমাকে দাও…. আমি আমার রঙে ছুপিয়ে দিই…. এসো এসো….. আমার কী রঙ? আলোর যে রঙ। আনন্দ।