Skip to main content
 
 
 


---
হরিদাসীর সকাল থেকেই মন খারাপ।
রাণাঘাটের কিছু দুরে তার বাড়ি,
ছোট্ট একটা গ্রামে
রেল লাইনের কিছুটা দূরে,
বাড়ি থেকেই ট্রেন আসার শব্দ যায় কানে।
মৈত্রী এক্সপ্রেস- এদেশ ওদেশ ট্রেন।
হরিদাসী প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে আসে
রেল লাইনের ধারে
ঝড় জল বৃষ্টি, শীত গ্রীষ্ম
                 ভুল হয় না তার।
তবে এ কদিন তার যাওয়া হয় নি,
ধুম জ্বর কদিন হল,
ঘোরের মধ্যে ছিল।
কাল রাতের বেলা ফিরেছে জ্ঞান।
তখন থেকেই বুকের কাছে ব্যাথা
কতদিন হল না যে দেখা, মৈত্রী এক্সপ্রেস।


-----
হরিদাসীর বয়স সত্তরের উপর হবে
ঘরেতে তার পঙ্গু ছেলে,
ছেলের বউ আর নাতি, বছর আটেক সবে।
তার নাতি, পরিমলই বলেছিল,
"দেখ ঠাকুমা, মৈত্রী এক্সপ্রেস,
ওটা বাংলাদেশে যায়, আবার আসে"
ঠাকুমা - নাতি ভিক্ষা করছিল
কাঁচরাপাড়া স্টেশানে,
হরিদাসীর ভিক্ষার ঝুলি
হাত থেকে গিয়েছিল পড়ে।
মাথাটা ঘুরে বসে পড়েছিল
পরিমলকে ধরে।
ঢাকার থেকে ট্রেন! তার বাড়ির উপর দিয়ে?!
তার চোখের কোল গড়িয়ে জল পড়ল
তার অনেক দিনের না-কাচা
কালচে হওয়া থানে।
হরিদাসী একে তাকে জিজ্ঞাসা করে জানে
কবে কবে যায় সে ট্রেন এদেশ ওদেশ ছুঁয়ে।
না না, সে যাবে না,
চোখের বাকি আলোটুকু মেলে,
দেখবে শুধু চেয়ে-
দেখবে 'বাংলাদেশ' ওই ট্রেনে
তার ফেলে আসা মাটির গন্ধ বাতাস মেখে
তার বাড়ির কোল ঘেঁষে
ছুটছে সে ট্রেন ধেয়ে।


----
হরিদাসীর তখন বয়স পঁচিশ হবে।
খুলনা জেলায় বাড়ি,
সুরেশ, তার স্বামী, পাঠশালায়
                শিক্ষকতা করে।
তার ছেলে, সুবীর তখন বছর পাঁচেক হবে।
রাতারাতি দেশ ভাগ হল
খুলনা গেল বাংলাদেশে।
রাতের বেলায়, কয়েকজন এসে ঢুকল
জোর করে,
ঘুমন্ত তার স্বামী জাগল না আর
রক্তে ভাসল বিছানা মেঝে,
চক্ষের নিমেষে পর হল তার ভিটে।
সেই রাতেতেই হরিদাসী
বুকে নিয়ে নারায়ণ শিলা আর ছেলে
দৌড়.... দৌড়.....দৌড়........
সব ফেলে... হ্যাঁ.. হ্যাঁ...সব ফেলে।
রাতের পর রাত কাটল জঙ্গলে জঙ্গলে
দিনে কখনো কচুর ডাল মুখে করে
          জলের তলায় ডুবে।
শতচ্ছিন্ন বেশে
পৌঁছাল এ দেশে।
তারপর?
তারপর আর তারপর জুড়ে অনেক কাল গেল
ছেলে যদি বা বড়ো হল
পঙ্গু হয়ে শুলো।


-----
মৈত্রী এক্সপ্রেস যেদিন যেদিন যায়
সে লাইনের ধারে দাঁড়ায়।
তার ইঞ্জিন সে চেনে, চেনে বগিগুলোও।
কিছু লোকের মুখ দেখা যায়, আবার যায় না
অনেক মুখও।
ইঞ্জিন যখন আওয়াজ করে ডাকে
হরিদাসীর মনে হয়, সে যেন তার নাম ধরেই
ডাকতে ডাকতে ছোটে...
হরিদাসী..হরিদাসী....হরিদাসী..
সে হেসে তাকায়, সলজ্জ মুখে।
ট্রেন জানে তার বরের সোহাগ?
তার সুখের দিনের
জর্দার গন্ধ আর পানে রাঙা ঠোঁট- জানে?
ট্রেনটা যখন ঝড়ের বেগে ছোটে
তার লাইনে চাকার আওয়াজ
বলতে বলতে যায়-
জানে..জানে...জানে...
সে শীতের দিনে লাইনের পাশে আঁচল পেতে
শোয়।
কেউ না থাকলে, লাইনটাকে আদর করে ছোঁয়,
এ লাইন তার সোহাগ দেশে গেছে।


-----
আজ তার ওঠার শক্তি নেই।
জানে সে একটু পরে, তার বাড়ির আঙিনা
ছাড়িয়ে একটু দূর দিয়ে, যাবে মৈত্রী এক্সপ্রেস।
হরিদাসী ডাকল ক্ষীণ কণ্ঠে,
"পরিমল, একটু আয় তো"
"কি ঠাকুমা?"
"সেইটা দে তো?"
পরিমল বোঝে
হরিদাসী কি খোঁজে-
সেদিন রাণাঘাটে,
দাঁড়িয়েছিল মৈত্রী এক্সপ্রেস সিগন্যাল না পেয়ে।
ঢুকেছিল পরিমল একটু সুযোগ পেয়ে।
বাথরুমের দরজার কাছে পেল এক টুকরো কাগজ।
তাতে 'ঢাকা' কথাটা লেখা।
ঢাকা মানেই বাংলাদেশ, পরিমল জানে।
যদিও তাকে চড় মেরে নামিয়েছিল পকেটমার ভেবে।
সে সব কথা থাক,
গরীব লোকের সহজ হিসাব, পরিমল বোঝে।
তাই সে চড় ভুলে,
ঠাকুমার হাতে দিল, এক গাল হেসে-
"এই দেখো গো সাবানের খোসা তোমার দেশের!"
হরিদাসীর বুক ভেসেছিল, চোখ ভেসেছিল জলে,
পদ্মার ঢেউ আছড়ালো যেন
বুকের পাঁজর ওথাল পাথাল করে।
তাই আজ হরিদাসীর একটা ইঙ্গিতে
পরিমল দৌড়ে গেল সিংহাসনের কাছে,
ঠাকুরের আসন তলা থেকে বার করল
সেই ছেঁড়া, কুড়িয়ে পাওয়া
সাবানের প্যাকেট
দিল হরিদাসীর হাতে।
হরিদাসী শুঁকল, মাথায় ঠেকাল, চেপে ধরল বুকে।
হরিদাসীর চোখ বন্ধ, সে দেখছে-
তার বাড়ির উঠোন ছুঁয়ে যাচ্ছে মৈত্রী এক্সপ্রেস-
তার ইঞ্জিন তাকে ডাকছে-
হরিদাসী.... হরিদাসী....হরিদাসী....
তার বর তাকে ডাকছে
হরিদাসী... হরিদাসী.....হরিদাসী..
তার হাতে তৈরী তুলসী মঞ্চ, গোবরে নিকানো
উঠান, তার বাগানের আম, জাম, টিয়ে, দোয়েল
সব এসেছে মৈত্রী এক্সপ্রেসে চেপে, তার উঠানে
সবাই ডাকছে
হরিদাসী....হরিদাসী...হরিদাসী....
হরিদাসীর শ্বাস উঠছে বেড়ে
ঘাম হচ্ছে কুলকুল করে।
বুকের খাঁজে দেশ ভাগের ব্যাথা
ছটফটিয়ে ডানা মেলে
বসল গিয়ে
মৈত্রী এক্সপ্রেসের ছাদে।

হরিদাসীর দু'চোখ বেয়ে নদী
সে বলল-
আমি আসছি...আসছি....আসছি....

 
 
 
(ছবিঃ সুমন দাস)