মুখের উপর সকালের রোদ এসে পড়েছে। ভোরের রোদের সঙ্গে কথা বলে প্রশান্ত। ভোরের রোদের সঙ্গে ছোটোবেলার যোগাযোগ আছে। চোখটা বন্ধ করে আছে। তবু বন্ধ চোখের পাতার উপর দিয়েও আলোকে অনুভব করা যায়। সামনে পুকুর থেকে হাঁসেদের ডাক আসছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। শীত যাবে। যাক। কে-ই বা থাকে! সে নিজেও কি থাকবে?
প্রশান্তর অনেক ঝুটঝামেলা সামলাতে হয় রাতদিন। সংসারে। কাজের জায়গায়। সে সব নিয়ে মাথা ভার হয়ে যায়। হাঁসফাঁস লাগে। কিন্তু মনের গভীরে কোথাও জানে, এ সব বেশিদিন থাকবে না। কিছুই বেশিদিন থাকে না। এটা ভাবতে ভাবতেই সব বদলে যায়। মানুষ চীৎকার, দেওয়ালের রঙ, পাখা ঘোরার শব্দ, রাস্তার গাড়িঘোড়ার আওয়াজ, সব বদলে যায়। এই সাধারণ কথাটা অনেক কিছু দিয়েছে প্রশান্তকে। অনেক কিছু হারিয়ে এই কথাটাকে শিখেছে। অনেক ভালোবাসা, অনেক স্বপ্ন হারিয়েছে। ক্ষোভ নেই আর। শান্ত হতে শিখেছে প্রশান্ত। অকারণে দৌড়াদৌড়ি করে লাভ নেই।
নিজের মাথার মধ্যে যখন জট পাকিয়ে যায় সব, কোনটা সত্যি, কোনটা আসল বুঝে উঠতে পারে না, তখন একটা খেলা খেলে প্রশান্ত। নিজেকে একটু দূরে নিয়ে যায় সবার থেকে। একটা চারাগাছ খোঁজে। যে গাছটা কয়েকটা গাঢ় সবুজ পাতা মেলে, সদ্য বীজ থেকে বেরিয়ে, মাথা তুলেছে আলোয়, আকাশের দিকে। প্রশান্ত হাঁটু মুড়ে বসে সেই গাছের সামনে। তারপর নিজের দিকে তাকায়, মনে মনে। গাছটাকে কি বলতে ইচ্ছা করছে তার? কি বলতে প্রাণটা আটুপাটু করছে? কোন কথাটা সব চাইতে দরকারি? চারাগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথার মধ্যে সে কথাটা স্পষ্ট হয়ে আসে। ওইটাই আসল কথা। বাকি যা, সে সব এলোমেলো কথা। অসামঞ্জস্যের কথা। সামঞ্জস্য না থাকলে সংসারে কিছুই নেই। সামঞ্জস্য মানেই সত্য।
প্রশান্ত খানিক আগেই এ খেলাটা খেলেছে। মাথাটা স্পষ্ট হয়ে আছে। দিন যাবে। আবার গুলিয়ে যাবে সব। আবার অস্থিরতা বাড়বে। এ নিয়ম। কিন্তু সেটাই বড় কথা নয়। আবার সব গুছিয়ে আনতে হবে। গুছিয়ে আনতে নিজের মধ্যে সব কিছু। আবার সবার থেকে দূরে গিয়ে বসতে হবে। আবার একটা চারাগাছ খুঁজতে হবে।
==========
প্রশান্ত চোখ খুলল। পুকুরে কোনো হাঁস নেই। ওরা রোদে বসে আছে ওই দক্ষিণদিকে। সে বসে আছে পশ্চিমপাড়ে। পূর্ব পাড় থেকে সূর্য উঠেছে এই সবে। চারাগাছটা মাঘের শীতল হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে। হাওয়ার ধাক্কা সামলাতে শিখছে।
যে সব মুখ মনে করলে মনটা বিষিয়ে যায়, এই সময় তাদের মুখ মনে করতে নেই। ওরা থাকবে। সেও থাকবে। হাওয়ায় ভাসা ঝরা পাতার মত কে কখন কার পাশে আসে, কতক্ষণ থাকে তার কোনো ঠিক আছে? কেউ জানে না। জানার দরকারও নেই। খুব শান্ত হলে মাথাটা, গোটা সংসারের মধ্যে একটা শ্বাসপ্রশ্বাস শুনতে পাওয়া যায়। কে যেন অনন্তকাল ধরে সবটুকুকে নিয়ে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে সৃষ্টি করছে, আবার গুটিয়ে নিচ্ছে নিজের মধ্যে। কিচ্ছু হারায় না। তৈরি হয়, আবার মিলিয়ে যায়। ঢেউয়ের মত।
মা, বাবার পাশে বসে পুরীর সমুদ্রের ঢেউ দেখতে দেখতে মিষ্টি খেয়েছে, কত ছোটো তখন। মনে হত গোটা সংসার মিষ্টিই খাচ্ছে শুধু। এত মারামারি, এত হানাহানি, এসব বুঝতে বুঝতে, বড় হতে হতে, পাশ থেকে মা বাবা মিলিয়ে গেছে। ঢেউয়ের মত। আরো কত কি মিলিয়ে গেল। যেন গোটা ছোটোবেলার ঘরটা সব খেলনাপাতি নিয়ে বানের জলে ভেসে গেল। থেকে গেল শুধু রোদ। ছোটোবেলাকার রোদ। আজও আছে। থাকবেও। গোটা সংসার ঢেউয়ের মত হচ্ছে, ভাঙছে। মিষ্টি খেতে খেতে দেখার জিনিস নয় এ। নোনতা জলে একে বুঝে নিতে হয়। সমুদ্রের জলের মত নোনতা চোখের জলে।
===========
প্রশান্ত উঠে দাঁড়ালো। মাথাটা হালকা। সাইকেলে উঠল। ফিরতে হবে। পৌঁছাতে ঘন্টা খানেক লাগবে। চা খেতে হবে। মিনিট পনেরো চালিয়ে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ালো। সদ্যই খুলেছে মনে হল। একদিকে কচুরি ভাজার আয়োজন চলছে। আরেকদিকে চা। বেশ কয়েকজন খদ্দের এসেছে দোকানে।
প্রশান্ত এক কাপ চা নিয়ে, স্ট্যাণ্ড করা সাইকেলটার পাশে এসে দাঁড়ালো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখল একটা অল্প বয়েসী বউ কচুরী ভাজতে বসল। চা করছে যে সে কি শ্বশুর তবে? প্রশান্তর চোখে দুবার চোখ পড়ল বউটার। মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। হাসল কি? আবার তাকাবে কি সে?
পিছন ফিরে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়ালো প্রশান্ত। লরি যাচ্ছে সাঁ সাঁ করে। বড় রাস্তায় ঝুঁকি অনেক। কিন্তু এ ঝুঁকি, না লোভ? প্রশান্ত নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল। মাথাটা ঠাণ্ডা। এ লোভ। লোভ অবিবেচকের মত ঝুঁকি নেয়। এ ভয় নয়, আতঙ্ক। লোভের ভয়ে আতঙ্ক কাজ করে, আশঙ্কা নয়। অশান্ত মনে ভয় জন্মায়। সে ভয় আতঙ্ক, না আশঙ্কা? জীবনে কর্তব্য অনেক। ঝুঁকি না নিয়ে জীবনের কোন কর্তব্যের মোড় পার করা যায়? কিন্তু কর্তব্যের ঝুঁকিতে বুদ্ধি হাতুড়ির মত বিপদের শেকল ভেঙে ভেঙে এগোয়। এ ঝুঁকি নয়। এ লোভের হাতছানি। শরীরের লোভ শরীরকে ডেকে আনে খেলায়। শেষে সব শূন্য, শুষ্ক। যদি ভালোবাসা না থাকে।
কিন্তু তার জীবনে যে ভালোবাসা এসেছিল? উদ্দাম যৌবনের সাগরে ডিঙির মত তার আর জুঁইয়ের শরীর ঢেউ ভেঙে ভেঙে এগিয়েছিল! সেদিন শরীরকে আলাদা করে শরীর বলে কই মনে হয়েছিল? শরীর যেন একতারা। জুঁইয়ের ছোঁয়ায় সহস্র তার হয়ে উঠেছিল। স্বর্গ থেকে গন্ধর্ব, অপ্সরা সবাই এসে যেত তাদের খেলায়। ওই চার দেওয়ালের মধ্যেই পারিজাত ফুটত। আমোদিত হত মন।
কিন্তু জুঁই বিয়ে করল না তাকে। জুঁইয়ের মন বদলে গেল। ওদের বাড়ির সামনে দামী গাড়ি দাঁড়াত। সে গাড়িতে উঠে যেত। তখন জুঁইয়ের ফোনে তার নাম্বার ব্লক। জুঁইয়ের বাড়ি সে কোনোদিন যায়নি। দূর থেকে দেখেছে। জেনেছে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। প্যাণ্ডেল হতে দেখেছে। দূর থেকে। ছেলেটার নাকি বিরাট ব্যবসা।
ভালোবাসায় যতটা আত্মবিশ্বাস থাকে, অধিকারবোধের ততটা থাকে না। সব সময়েই মনে হয় আমি কি যোগ্য? প্রশান্ত নিজের মনকে উল্টেপাল্টে কতবার দেখেছে। খুঁত পেয়েছে। অভাব পায়নি। সীমাবদ্ধতা পেয়েছে। সঙ্কীর্ণতা পায়নি। কিন্তু সব খামতি কি ক্ষমার যোগ্য? কেন মেনে নেবে জুঁই তাকে? তার সব সীমাবদ্ধতাকে? ভালোই করেছে।
চোখের কোলে জল। শীতের হাওয়ায় ব্যথা দিল। ঘুরে তাকালো। যে কচুরী বেলছিল সে বউয়ের মুখের দিকে তাকালো। কই সে বিদ্যুৎ আর? একটা মায়া জন্মালো। মাধুর্য মাখা মায়া। ভালোবাসা সদ্য জন্মানো চারাগাছের নিষ্পাপ মাধুর্যের মত। নিষ্পাপ মনের এক ক্ষমতা থাকে। নির্মল যে সত্য, তাকে খুঁজে দেওয়ার, তাকে সহ্য করার ক্ষমতা দেওয়ার। জুঁইয়ের উপর ভালোবাসা সে চারাগাছের মত। এখন আর লোভ কাছে ঘেঁষবে না। এখন তাকে ঘিরে থাকবে নদীর মোহনায় আসার মত উদাসীনতা। চারদিক বড় নিটোল এখন। লোভ বড় ছদ্মবেশী।
প্রশান্ত ফিরছে। খানিক ব্যথা, খানিক সুখ, খানিক আনন্দ, খানিক ভরসা, খানিক কুয়াশার মত অজানা আশঙ্কা মোহনার জলে চিকচিক করছে। থাকবে না কিছুই। তবু যেতে হবে সবটা রাস্তা পেরিয়ে। যতটা রাস্তা মাপা তার জন্য।
প্রশান্ত জিভে সেই মিষ্টি স্বাদটা আবার পাচ্ছে। যেন পুরীর সমুদ্রের ধারে বসে আবার। বালির উপর জন্মে চারাগাছ। তাকে বলছে, আমি তো আছি!