লোকটা বেলচা করে ময়লা তুলছিল। ময়লার গাড়ি এসেছে সকালবেলা। বিশ্রী বোটকা গন্ধ। শহরের ময়লা মানুষের তৈরি ময়লা। লোকটার আগে কৌতুহল ছিল। এখন নেই। ময়লার রকমেরও সীমা আছে। কিন্তু মাত্রা নেই পরিমাণের। লোকটা উদাস। বেলচা চলছে নিয়মমাফিক ঘচাঘচ।
ঘটাং!
কিসের আওয়াজ? লোকটা চমকে তাকালো। বেলচাতে ঠেকছে ধাতব ধাক্কা। লোকটা বেলচাটা ডানদিকে রেখে দুহাতে ময়লা সরাতে লাগল। সরাতে সরাতে পেল একটা পেতলের ঘড়া। চকচক করছে গা। এই ময়লার মধ্যেও। মুখটা বাঁধা।
মুখটা সরাতে লোকটার মুখ 'হাঁ' হয়ে এলো। মুখের মধ্যে ময়লার গন্ধ ঢুকল - ভক্! এত মোহর!? কাল রাতে তো মাল খায়নি। তবে? ভালো করে মনে করল। মঙ্গল-শনিবার করে তো সে মাল খায় না। আজ তো বুধবার, তবে? দরদর করে ঘামছে। বুকের ভিতরটা ধড়াস-ধড়াস করছে। মাথাটাও টাল খাচ্ছে মনে হচ্ছে। তাকিয়ে দেখল আশেপাশে কেউ নেই। কিছু ময়লা গাড়ি থেকে এনে আবার চাপা দিয়ে দিল। এখন নেওয়া যাবে না। কার না কার চোখে পড়ে!
সারাটা দিন ডাস্টবিনটার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। কত লোক ময়লা ফেলতে এলো। কত কুকুর হিশু করে গেল। কত কাক, শালিখ, বেড়াল, কুকুর খাবার খুঁজে গেল। একটা ষাঁড় পর্যন্ত!
সে সারাটা দিন তাড়াল। পাহারা দিল। দুর্গন্ধ শুঁকলো।
রাত দুটো হল। রাস্তা শুনশান। সে ধীরে ধীরে ডাস্টবিনের কাছে এলো। একটা ঘেয়ো কুকুর ঘুমাচ্ছিল। তাকে লাথি মেরে তাড়াল। ময়লাগুলো সরাতে লাগল দু'হাত দিয়ে। সারাটা দিন খাওয়া হয়নি। তবু দুর্বল লাগছে না। ঘুম পাচ্ছে না। দুর্গন্ধটাও সয়ে গেছে।
এই তো ঘড়াটা! মুখের কাপড়টা সরালো ঘড়ার। স্ট্রীট লাইটের নীচে নিয়ে এসে কয়েকটা মোহর গুনলো। কি এগুলো? সোনা? না পাথর? বুঝছে না।
হঠাৎ মুষড়ে পড়ল। তার বাড়ি বালিয়ায়। কাল দুপুরে শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরবে? পরেরদিন ভোরে পৌঁছে যাবে। তারপর? এগুলো রাখবে কোথায়? ক্ষেতে পুঁতে রাখবে? তা কি করে হয়? ক্ষেত তো তার একার নয়, তাছাড়া লোকের কৌতুহল অনেক বেশি সেখানে। তবে? এখানে রাখবে? কিন্তু যে বস্তিতে সে থাকে সেখানে একটা ঘরে চারজন শোয় তারা। সব ক'টা লুচ্চা শালা। এরমধ্যে পগাটা তো জেল ফেরৎ আসামী।
লোকটার কান্না পেল। কি করবে সে এখন? কি মরতে দেখতে পেয়েছিল। উফ্, ভগবান, হা বজরংবলী, কি বিচার তোমার? রাখব কোথায়?
হঠাৎ বাঁশির শব্দে ঘোর ভাঙল। পাহারাদার আসছে। দৌড়ে গিয়ে আবার ডাস্টবিনে লুকিয়ে ফেলল। ঘেয়ো কুকুরটা আবার ঘুমাচ্ছে। ওর পাশেই শুলো। পাহারাদার তার দিকে এগিয়ে এসে লাঠি দিয়ে খোঁচালো। সে সাড়া দিল না। "মাতাল শালা", বলে চলে গেল।
লোকটা কাজ ছেড়ে দিল। সারাদিন তার পাগল পাগল লাগে। কেউ কাছে এলেই তাকে তাড়া করে। ময়লার ভিতর থেকে এটা ওটা খুঁজে খায়। লোকে বলে 'ময়লা পাগল'। রাতে কাঁদে। দিনে এলোমেলো কথা বলে। আর কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। এমনকি পাড়ার ষাঁড়টা পর্যন্ত এড়িয়ে যায়।
মিনু বিগবাজার থেকে ফেরার সময় রোজ খেয়াল করে পাগলটাকে। বলে, পাড়ায় শালা নতুন আমদানি হল। আবার অন্যমনস্ক হয়। ক'দিন ধরেই অন্যমনস্ক। তার ছোটোবেলার পেতলের ঘড়াটা হারিয়েছে ক'দিন হল। তার ছোটোবেলা থেকে পাথর জমানোর নেশা। সে আর তার দাদা গুপ্তধন গুপ্তধন খেলত। হয় সে লুকাতো, নয় তার দাদা। দাদা নিজেই লুকিয়ে গেল। হেরে গেল। আত্মহত্যা করল। কারণ এখনও জানে না মিনু। তার মনটা উদাস হল।
পাগলটার দিকে এগিয়ে গিয়ে দশ টাকার একটা কয়েন ছুঁড়ে দিল। পাগলটা "আরে মোহর মোহর" বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা নিল। তারপর ময়লার মধ্যে লুকিয়ে ফেলল। একটা ধাতব আওয়াজ হল - 'ঘটাং!'
মিনু শুনতে পেলো না।