ঝড় উঠল। গোঁসাই ফিরছে আশ্রমে। একতারা আর ধুতি সামলাতে সামলাতে গোঁসাই আশ্রমের দরজায় এসে বলল, কখন এলে গো…..
আমি হাত থেকে একতারাটা নিয়ে বললাম, এই তো… সারা গা-মাথা ধুলোয় ধুলো দেখি….
গোঁসাই 'হো হো' হাসতে হাসতে কলপাড়ে গেল…. পা ধুতে ধুতে বলল, তা তুমিও তো কম ধুলো পেরিয়ে আসোনি দেখছি… মুখখানা অমন অন্ধকার কেন?
বললাম, কোনো বিশেষ কারণ কি লাগে গোঁসাই সংসারে?…. সুর চড়ে থাকবে সংসারে এমন মন কি পেয়েছি…. আঘাতে ধাক্কায়…. সুর কখন নেমে যায় বুঝি না…. যখন দেখি নামতে নামতে গোঙানিতে এসে ঠেকেছে….
কথা শেষ করতে পারলাম না…. গলা বুজে এলো…..
আরতি শুরু হল। পঞ্চপ্রদীপের আলোয় শ্রীবিগ্রহের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ঝড়ে কারেন্ট গেছে। আজ আর আসবে বলে মনে হয় না। গোঁসাই খালি গায়ে টানটান হয়ে বসে। খুব সম্ভবত চোখ বন্ধ। কিম্বা খোলা, শান্ত দৃষ্টি। ঝিনুকের খোলে বৃষ্টির জলে যেমন আকাশের ছবি জমে ওঠে, গোঁসাইয়ের চোখে ভালোবাসা জমে তেমন দৃষ্টি।
======
গঙ্গার ধারের দিকে ঘরে এসে বসলাম। বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
গোঁসাই বলল, সুর নেমে যায়…. কিন্তু সেই নেমে যাওয়াটা যে বুঝতে পারো.. এই গোবিন্দের কৃপা…. নইলে কতজনে তো সেই নামা সুরেই বিশ্বকে বাঁধতে চায়…. বাঁধে না… তখন ভিতরে বাইরে অভাবে-অভিযোগে নিজের প্রাণ… সক্কলের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলে গো…
গোঁসাই হেসে উঠল। করুণ হাসি। আপন মনে বলল, সুখের ক্ষেতে মনের গরু…. চরছে তো চরছেই…. ঝড় এলে…. যাবেই বা কোথায়…. গোবিন্দের বাঁশি শোনার অভ্যাস নেই যে…… তাই ফেরার পথও পায় না…..
বললাম, মন তো এমনই গোঁসাই…..
গোঁসাই উঠে জানলার কাছে দাঁড়ালো। বলল, দেখ্… গঙ্গা দেখতে পাচ্ছিস? বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছিস….?
বললাম, না।
আরেকটু তাকিয়ে থাক।
তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠল। গঙ্গার বুকের বৃষ্টির ধারা মুহূর্তে দেখলাম… আবার সব অন্ধকার।
গোঁসাই বলল, দেখলি রে…. এমনিই দেখ্, কান পাতলে বৃষ্টির আওয়াজ, গঙ্গার জলের পাড়ে লাগার ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ শোনা যায়। তেমন বুকের মধ্যে একটা 'আমি আমি' শোনা যায়…. ভাবনার অন্ধকারে সে 'মহাআমি' চাপা পড়ে থাকে। হঠাৎ কোনো বড় দু:খে… কি আঘাতে…. বিদ্যুৎ চমকে যায়…. বুকের ভিতরে সে 'মহাআমি'কে দেখা যায়…. আছে না রবি ঠাকুরের গানে….. আমার প্রাণে গভীর গোপন মহা আপন সেকি…. অন্ধকারে হঠাৎ তারে দেখি….. যবে দুর্দম ঝড়ে আগল খুলে পড়ে… কার সে নয়ন পরে নয়ন যায় গো ঠেকি…. মহা আপন সেকি…."
গোঁসাই গাইছে। উদাত্ত গলায়। প্রদীপ কেঁপে কেঁপে উঠছে বাদল বাতাসে। আমার চারদিকে জুড়ে হঠাৎ কিরকম সব জমাট বাঁধা অর্থপূর্ণ কিছু হয়ে উঠল। কে আমি? কিচ্ছু নই… আমার চোখ ভেসে যাচ্ছে… অনির্বচনীয় আনন্দে না দু:খে জানি না…. নিজেকে সামলে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কে গোঁসাই… কে?
গোঁসাই কাছে এসে, আমার মাথার উপর হাত রেখে বলল, ভাবনার স্রোত গো…. ভাবনার স্রোত…
থামে না….
সময় হলেই থেমে যায়…. কান্নায়…. গভীর আকুতিতে সব থেমে যায়….. ভাবনা থামালে যে থাকে সে…. শুধু সে-ই থাকে….. সে আমি নই…. তুমি নও….. সে সময় নয়…. বাহির ভিতর কিছুই নয় সে…. সে সব…. মহা-আপন…. তখন গোটা সংসার জুড়ে শুনবে 'আমি আমি' ধ্বনি…. সে আমি'র বাইরে কেউ নয়…..
আমি বললাম, তোমার গোবিন্দ…..
গোঁসাই হাসল। বলল, বাইরের গোবিন্দ বাইরে তুমি…. ভিতরে এলে আমি….. তাই না সে রাধার সুখ!….. গোবিন্দ সুখ…. বাইরের তুমি'কে ভিতরের আঙিনায় আমি করে পাওয়ার সুখ….. যেন চাঁদের আলো তোমার ঘরের জানলা দিয়ে এসে তোমার সিংহাসনে রাখা ঘটের জলে পড়েছে… বিচ্ছুরিত হচ্ছে…. সে আলোয়… সারা ঘর আলোয় আলো….
======
ফিরছি। স্টেশানে বসে। মেঘ কেটে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। স্টেশান, রেললাইন সব চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে। একই আলো… একই বাতাস… একই আকাশ…. বুকের ভিতর একই কান্না গোঁসাই….. কি করে দিলে… সব শান্ত… সব স্নিগ্ধ…. এই তো সুরে বাজছে সব গোঁসাই…. এই তো সুরে বাজছে।