সৌরভ ভট্টাচার্য
15 February 2019
ভালোবাসা সব গল্পে, সিনেমায়, কবিতায়, স্কুলে, কলেজে জমা রেখে মুদছুদ্দিবাবু লাইব্রেরীতে তালা দিয়ে যখন অটোতে উঠলেন, তখনই পেটটা মোচড় দিল। একবার ভাবলেন নেমেই দৌড় লাগাই লাইব্রেরীতে, কিন্তু এই কাটোয়া লোকালটা মিস হয়ে গেলে যাচ্ছেতাই একটা ব্যাপার হবে, ভাইয়ের নাতির অন্নপ্রাশন আজ। যদিও ছুটি নিলেই ভালো হত, কিন্তু লাইব্রেরী না এসে থাকা যায়! ভাবতেই পারা যায় না।
অটোতে যেতে যেতে বুঝলেন স্টেশান অবধি যাওয়াটা সমস্যা হবে। গুলাটি মোড়ে নেমে পড়লেন। এখানে একটা সিনেমা হল আছে, যদি ওদের টয়লেটটা ফাঁকা পাওয়া যায়। গেলেন, টয়লেট আছে, কিন্তু দরজা নেই, জলও নেই। মুদছুদ্দিবাবু বুঝতে পারলেন যে বেগটা আসছে তাতে ব্যাপারটা সুবিধার না, তারলিক। এই অবস্থায় জল ছাড়া... সাদা ধুতি... না না... থাক।
ফিরে আবার রাস্তার মোড়ে দাঁড়ালেন। অটোর আশায়। আচমকা কানের কাছে কে বলে উঠল, "ঝোপে যা না..."
ধাঁ করে পিছনে ফিরলেন, কেউ নেই। কয়েকটা লোক ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে, আর রিকশা, সাইকেল, বাইক কয়েকটা। মনের ভুল?
কিন্তু ঝোপ কোথায় এদিকে?
আবার শব্দ, "সিনেমা হলটা পিছনে রেখে সোজা পুবে হাঁটলেই দশ মিনিট পর একটা দীঘি। ওর পাশে ঝোপ। কাজ সেরে দীঘির জলে ইয়ে পরিস্কার করে, ইচ্ছা হলে নেয়েও ফেরা যায়।"
মুদছুদ্দিবাবু হয়ত কিছু ভাবতেন। কিন্তু কেসটা প্রায় দোরগোড়ায়। আর রিস্ক নিলে মাখামাখি। উনি এক প্রকার দৌড়ই লাগালেন। সত্যিই ঝোপ। পাশে দীঘি।
কাজ সেরে দীঘির পাড় থেকে যখন উঠতে যাবেন চোখ ঘুরে গেল। সার দিয়ে পলাশ গাছ। পলাশ ফুটে আছে থরে থরে। উফ! কি অপূর্ব। মুদছুদ্দিবাবুর আবেগ আসলে চোখে জল আসে, নাকটা সুড়সুড় করে, রেখার জন্য কান্না পায়। রেখা তার বান্ধবী ছিল কলেজের। বিয়ে করেছে মুদছুদ্দিবাবুর সাথে প্রেম করে বড়লোকের ব্যবসাদার ছেলেকে।
কান্নাটা প্রায় পেয়ে এসেছিল, হঠাৎ সেই আওয়াজ, "মর মিনসে, এতো কাঁদতে বসল দেখি, সে মাগী তো নাতনির বিয়ের দিন মরেছে রে মুখপোড়া..."
মুদছুদ্দিবাবু কিছুক্ষণের জন্য নিজের মধ্যেই যেন ভ্যানিশ হয়ে গেলেন। দুঃখ পেলেন, সাথে একটা মুক্তির আনন্দও। মনটা হঠাৎ কেমন নরম হয়ে গেল। বললেন, "আপনি কে? গলা শুনে তো পুরুষ নারী কিছুই বুঝছি না... ফ্যাসফেসে বায়বীয় গলা।"
"আমি নবলা।"
"নবলা?"
"তোমার লাইবেরিতে ঝাঁট দিতে আসতুম, সব ভুলে খাইসেন দেখছি... তা গলায় দড়ি দিলাম... আপনি মা'রে পাঁচশো টাকা দিলেন..."
"ও হ্যাঁ... তা তুমি মা পেত্নী হয়েছ?"
"মর মুখপোড়া... এমন সুরে বলছে যেন পোয়াতি হয়ে সুখের সাগরে নলেন গুড়ের মত ভাসছি..."
মুদছুদ্দিবাবু একটু থতমত খেলেন। আসলে তিনি একটু অপ্রস্তুত বোধ করছেন। এর আগে ভুত বা পেত্নীর সাথে কথা বলেননি কিনা। তাছাড়া দেখা যাচ্ছে না কথা হচ্ছে... যদিও ফোনে হয়, তবু হাতে কিছু তো একটা থাকে, সে ফোনই না হয় হোক।
"ট্রেন তো পাবে না।"
"না, তা তুমি হঠাৎ মরলে কেন?"
"ওই তারকের জন্য। ভালোবাসল। ঝোপে নিয়ে গেল। পেট করল। তারপর মুম্বাই পালিয়ে গেল। বিধবা মা, সারা জীবন শালা মাতাল বাপটাকে ঝেলেছে... আবার এই... ধুর... গেলাম ঝুলে..."
সব চুপচাপ। এদিকটায় কেউ আসে না। দূরে রেললাইনে পাঁচটা পঁচিশের কাটোয়া লোকাল বেরিয়ে যাচ্ছে। যাক। পৃথিবীতে প্রেম নেই। শুধু বেইমান আর সুবিধাবাদীতে ভরতি। নবলা মরে বেঁচে আর সে নিজে বেঁচে মরে। রেখাও নেই। বুকটা টাটালো। প্রেম থেকে যায়। মানুষ আর বিশ্বাস মরে যায়।
"যা বলেছেন। আমি এখনও ওই মালটাকে ভালোবাসি জানেন। তারক, সে দু'মাস হল এসেছে। আবার একটা পাঞ্জাবি মাগী বিয়ে করে এনেছে। যাক গে, সুখে থাকুক। সে মাগী তো পোয়াতি। আমার আর কি, মা'টা মরলে গ্রাম ছেড়ে চলে যাব।"
"হ্যাঁ রে, রেখার সাথে তোর দেখা হয়?"
"না না, সে তো রেগুলার কেস। ওদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা। আর তুমিই বা কি করবে ওকে দেখে এখন। তোমার বাবার এই লাইব্রেরীটা ছিল বলে জীবনটা ওইসব ছাইপাঁশ পড়ে কাটিয়ে দিলে। গণ্ডমূর্খ তুমি একটা। এর চাইতে দশটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে টুক করে শুয়ে পড়তে।"
কথায় কথায় অন্ধকার হয়েছে। চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় পলাশগুলো যেন বুকের মধ্যে প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়ে যাচ্ছে। তার উপর বসন্তের হাওয়া। রেখা!
হঠাৎ একটা কিছু মনে হল মুদছুদ্দিবাবুর। এতক্ষণ মাটিতে বসে ছিলেন। এবার দীঘির ধারে শুয়ে পড়লেন। পাশে দীঘির জলে চাঁদের ছায়া। টুলটুল করছে।
"নবলা একটু শরীর ধর না, পারবি?"
নবলা বলল, "তোমার ডানকাতে সে কখন থেকেই তো দাঁড়িয়ে, সুর্য ডুবলেই আমাদের দেখা যায়, তারার মত।"
নবলা গান গাইছে গুনগুন করে। মুদছুদ্দিবাবু কাঁদছেন। এই প্রথম রেখার জন্য না। পেটের মোচড়ে না। নিজের জন্য। "নবলা, আমার সাথে থাকবি?"
নবলা গান থামাল। তার শরীরটা স্পষ্ট নয়। বলল, "এই চাঁদ, দীঘি, পলাশ, এমন বুক মোচড়ানো হাওয়া, এতেই তোমার মাথাটা খারাপ করছে গো। প্রেম বলে কিছু হয় না। ও বসন্ত রোগের মত। ক'দিন সারা শরীর মন আচ্ছন্ন। ঘোর। তারপর যেই কে সেই। কি হবে বলো? তুমি চাইলে সে শরীর দিতে পারি, শুধু আজকের রাতটার জন্য। নেবে?"
আবার কান্না পাচ্ছে। এবার নিজের জন্য না। নবলার জন্য। মুদছুদ্দিবাবু ডুকরে কেঁদে উঠে নবলার দিকে হাত বাড়ালেন। বায়বীয় শরীরটা নিজের দিকে টেনে বললেন, "প্রেম আছে রে মা, আছে, নইলে কিসের জন্য তুই, আমি এমন ফাঁকা কলসীর মত জীবন কাটালুম বল। ওরা যোগ্য ছিল না, বা হয়ত ওরা ওদেরই ছিল। সব বছরে কি আর সমান বর্ষা হয় বল? এ জন্ম না হয় খরাই গেল। পরের বারের জন্য নয় তোলা থাকল।"
নবলা চুপ। চাঁদ মধ্যগগনে। ভোরের ট্রেন চারটে বাইশ। মুদছুদ্দিবাবু কত বইয়ের গল্প বললেন নবলাকে। নবলা কথা দিয়েছে সে লাইব্রেরীর কার্ড করবে।
মিথ্যা বলব না, কথা রেখেওছে। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা এসে সে মুদছুদ্দিবাবুর চেয়ারটায় বসে টেবিলে পা তুলে পুরো রামায়ণটা পড়েছে। মুদছুদ্দিবাবু নিজের চোখে দেখেছেন। এখন রবীন্দ্রনাথ পড়াবেন। রবীন্দ্রনাথ না পড়লে মানুষ হয়েই বাঁচা যায় না, তা ভুত হয়েও কি পারা যায়?