শীতের কামড়ে গা এলিয়ে কল্যাণী সীমান্ত স্টেশানে বসে আছে মদন। রোদ এসে গা শুঁকে যাচ্ছে। কিন্তু কব্জা করতে পারছে না। পা'টা কনকন করছে। মদনের ইচ্ছা করছে আরেক ভাঁড় চায়ে চুমুক দেয়। কিন্তু দিয়ে কি হবে? গলা দিয়ে নেমে গেলেই তো হয়ে গেল। পাঁচ টাকা জলে গেল। থাক। কি দাম হয়ে যাচ্ছে, এক ভাঁড় চা পাঁচ টাকা, ভাবা যায়!
মদন স্কুলের মাষ্টার হবে ভেবেছিল। পরীক্ষায় উতরাতে পারেনি। আগে ভাবত তার যোগ্যতা ছিল না হয় তো। কিন্তু এখন এত দুর্নীতির খবর পড়ে ভাবে সত্যিই কি প্রশ্নটা যোগ্যতার? লকডাউনের পর টিউশান গোলমাল হয়ে গেছে সব। তার নিজের স্মার্টফোন থাকলেও তার সব ছাত্রছাত্রীদের তো ছিল না। তা ছাড়া অত টাকার নেটপ্যাক ভরবেই বা কি করে!
মদনের মাথায় চিন্তাগুলো সোজা রাস্তায় হাঁটত। জ্যাম লাগত, আবার ছেড়ে যেত। কিন্তু শেষ বছরটায় জ্যাম আর ছাড়ল না। মাথার মধ্যে এত এত শব্দ। কেউ এক ইঞ্চি এগোচ্ছে না। মদন হারিয়ে গেল। হঠাৎ একদিন দেখল সে খোলা মাঠের মধ্যে বসে আছে। কেউ কোত্থাও নেই। প্রথম প্রথম ভয় করত। কোনো দায়িত্ব নেই, এমন জীবন হয় নাকি? হল তাই। বাড়িতে যারা তার আশায় বাঁচত, তারা আর তার আশা করে না। বলে তার নাকি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে!
মদন এম এ পড়েছে। বিএড করেছে। পাঁচ টাকার চায়ের মত সব গিলে ফেলেছে। এখন বাদাম নিয়ে উঠবে ট্রেনে। মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো আর পীড়া দেয় না। শান্ত হয়ে খাঁচার মধ্যে বসে বসে মদনকে দেখে। আজকাল ধর্ম নিয়ে মানুষ অনেক কথা বলে, মদন ভাবে সে যদি ব্রাহ্মণ হত? যদি মন্দিরের পুরোহিত হতে পারত? যেদিন কাশী মন্দির নতুন করে উদ্বোধন হল, মদন টিভিতে দেখে কেঁদেছিল খুব। খায়নি দুপুরে। এত এত কিছু হচ্ছে চারদিকে সে শুধু বাদাম বিক্রি করবে? মদন ইতিহাস পড়েছে। কাশীর মন্দিরের ইতিহাস, কাশীর ইতিহাস সব জানে। কিন্তু তাকে ডাকবে না কেউ। সে তো মন্ত্র জানে না। ব্রাহ্মণ নয় তো।
ট্রেনে উঠল। এখন বিক্রি শুরু করবে না। কাঁচরাপাড়াটা যাক। ভিড় বাড়বে। মদন চশমাটা খুলে কাঁচ দুটো পরিষ্কার করল। মাইনাস থ্রি, দুটো চোখেই। তার ট্যালেন্ট কি আছে? ট্রেনে অনেকে গান গায়, বক্স লাগিয়ে। গান গাইতে পারলে রিয়েলিটি শো'তে গাইত। আজকাল ইউটিউবেও ছেলেমেয়েরা কত কিছু করে টাকা কামাচ্ছে, বাড়ি, গাড়ি করছে। বিয়ে করছে। তার ট্যালেন্ট কই? কিচ্ছুই পারে না। পড়াশোনাটাই যা মোটামুটি শিখেছে। মা নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করে। বাবা নেই। দুটো বোন। পড়ছে বড়টা। ছোটোটা ছেড়ে দিয়েছে। কাজ করে। কি যেন কাজ! থাক।
মদন চারদিকটা তাকালো। কাঁচরাপাড়ায় ভিড় হল না তেমন। আজ কি ছুটির দিন কোনো? রবিবার তো নয়! আচ্ছা নৈহাটি আসুক।
মদন দরজার কাছে বসল। ভিখারির মত। ইউনিভার্সিটির ক্লাস মনে পড়ছে। দুর্ধষ ব্রিলিয়ান্ট কিছু না হলেও, খুব খারাপ স্টুডেন্ট ছিল না। ব্যানার্জি স্যারের ক্লাস মনে পড়ছে। গোটা ভারতবর্ষ যেন ব্যানার্জি স্যারের গলা চিরে অতীতের কুয়াশা কাটিয়ে জীবন্ত হয়ে ক্লাসরুমে এসে দাঁড়াচ্ছে। স্বপ্ন ছিল ভারতটা ঘুরবে। মা বোন আর বউকে নিয়ে। ভাস্বতী। তাকে চাইত। বিয়ে হয়ে গেছে। ব্যাঙ্গালোরে থাকে। বর আইটিতে চাকরি করে।
ভারতটা ঘুরবে। মাকে ইতিহাস বোঝাবে। কিচ্ছু দেখল না, জানলো জীবনে মা। শুধু নার্সিংহোম আর বাড়ি করে গেল। এতবড় দেশ, এত এত ইতিহাস, শুধু রুগীদের হাগামোতায় চাপা থাকবে? কিচ্ছু জানবে না? বড় ভালো মানুষ মা!
হালিশহর পেরিয়ে গেল। ভিড় কম। অঙ্কিতা ম্যাডামের ক্লাস মনে পড়ছে। লাইব্রেরিতে নিজে নিয়ে গেছেন। নিজের হাতে করে বই এনে দিয়েছেন। অঙ্কিতা ম্যাডাম তর্কবিদ্যা শিখিয়েছেন। ইতিহাসকে কি করে নিজের মাথায় তর্ক করে খুঁজে নিতে হয় শিখিয়েছেন। সব ইতিহাসই ঐতিহাসিকের রুচিতে রাঙিয়ে যায়। ওর মধ্যে থেকে সত্যিটাকে খুঁজে নিতে হয়। অঙ্কিতা ম্যাডাম শিখিয়েছিলেন বায়াসড না হয়ে ইতিহাসকে দেখতে।
বারাকপুরে থাকেন ম্যাডাম। বারাকপুর এলেই লজ্জায় সঙ্কোচে কুঁকড়ে যায় মদন। যদি মুখোমুখি হয়ে যায়! যদি চোখে চোখ পড়ে! একবার হয়েছিল তো। মদন বাদামের প্যাকেটের সারি নিয়ে কোথায় লুকাবে? ভিড়ও ছিল না সেদিন ট্রেনে। ম্যাডাম কি চিনেছিলেন? নাকি চিনতে পারেননি? নাকি এড়িয়ে গিয়েছিলেন?
"পাঁচ টাকার একটা দেখি।"
খদ্দের।
মদন দেখল ট্রেন নৈহাটি ছেড়ে বেরোচ্ছে। মদন কথা বলতে পারল না। ট্রেনের কামরা ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুম মনে হচ্ছে। ক্লাস নিচ্ছেন নির্মল স্যার। কি করে আইএএস ক্র্যাক করা যায় বোঝাচ্ছেন। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে। মদন সবাইকে দেখছে। তার স্বপ্ন অন্য। স্কুলে পড়াবে। বাচ্চাদের নিয়ে ঐতিহাসিক জায়গায় যাবে। বাচ্চাদের মধ্যে ইতিহাস নিয়ে কৌতুহল তৈরি করবে।
এই… তুই এই কোচে কাজ করবি আজ?
একজন বাদামওয়াওলা দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে। মদনের মনে হল তার পিছনে তার বউ, ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়ালো। তারা বলছে, তুমি তো এত শিক্ষিত ভাই….. আমাদের ভাত কেন মারছ? তুমি তো চাইলেই চাকরি করতে পারো… মাস্টার হতে পারো…. অফিসার হতে পারো…
মদন তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। বলল, না না আপনি করুন… আমি পিছনের শান্তিপুরে কাজ করব। কাঁকিনাড়ায় নেমে যাব।
কাঁকিনাড়া ঢোকার আগেই শুনছে বাদাম বিক্রির সুর। কি আদরে খদ্দেরকে ডাকছে। সে যেন অমল। সে যেন অসুস্থ। সে যেন অপেক্ষা করছে ফকিরের। সব দরজা জানলা খুলে দিয়ে যাবে। রাজার চিঠি আসবে। নিয়োগপত্র। আসবে?
কাঁকিনাড়া স্টেশানে বসে মদন। শীতের রোদ সব ইতিহাসকে বুকে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে পড়ে আছে। কেউ তাকাচ্ছে না। সব বাদাম ছড়িয়ে হারিয়ে গেলেই হয়। যাবে? কিন্তু কোথায় যাবে? মাথার মধ্যে খাঁচায় পোরা স্বপ্নেরা আবার একদিন খাঁচা খুলে বাইরে আসবে। তার মাথা দাপিয়ে বেড়াবে। তাকে আবার ঘুমের ওষুধ দেওয়া হবে। মড়ার মত দিনরাত কেটে যাবে। না না, তা হয় না। শান্তিপুর লোকালের ঘোষণা হল। মদন শিরদাঁড়াটাকে টানটান করে নিল। কুয়াশা ভেদ করে আসছে ট্রেন। আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ভিখারির বাচ্চাগুলো সারা স্টেশান দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ওরাও ইতিহাস জানে না। ওরা জানে না ভারতের ঐতিহ্য। ওরা তারই মত দিনরাত শুধু প্রয়োজনের হিসাবনিকাশ করে। মেলে না। শিক্ষা বিলাসিতা। স্বপ্ন সীমা অতিক্রম করা মানসিক দৌরাত্ম্য।
ট্রেন দাঁড়ালো। মদন উঠল। ভিড় আছে। মুখে হাসি ফুটল। নিজেকে দেখে আশ্চর্য লাগে মদনের। মায়ের জন্য একটা মাইক্রোওভেন কেনার শখ। বেয়াড়া শখ। তবু বাঁচতে নিজেকে কিছুভাবে তো ভোলাতেই হয়। মরে যাবে না। কিছুতেই না। সব কেড়ে নিলেও না।