Skip to main content

 

আইসিইউতে লড়া শেষ। এতক্ষণে আমরা নেটিজেনেরা স্ক্রল করতে করতে জেনে গেছি নিশ্চয়ই যে মেয়েটা মারা গেছে। উনিশ বছর। দলিত। স্পাইনাল কর্ডটা ভাঙা ছিল। জিভটা কাটা ছিল। আরো ডিটেলিংস ছিল, পড়েওছি। লিখলাম না।

      আমাদের স্ক্রলিং একটা কর্তব্যের মত। আঙুলের সামান্য ওঠানামায় সম্পূর্ণ জগতটা কেমন বদলে যায় না? এই ধরুন টাইমস নিউজের এই খবরটা, আঙুলের কয়েক মিলিমিটার সঞ্চারণেই একটা জোক্স, কিম্বা একটা লাইভ গান, বা কিম্বা কারোর লেখা কবিতা বা গল্প বা প্রবন্ধ - রাজনীতি নিয়ে, কি তার জীবনের কোনো ঘটনা নিয়ে। মুহূর্তে জগতটা বদলে গেল। হয় ঠোঁটের কোণে হাসি ঝলক দিয়ে গেল, বা গম্ভীর হলাম, বা একটা উত্তেজক খবরের হেডলাইনে ডুবে গেলাম। কি আচম্বিতে জগতটা এদিক ওদিক হয়ে যায়। কোনো ধারাবাহিকতা নেই, কোনো সংগতি নেই, কোনো প্রেক্ষাপট নেই, কোনো উদ্দেশ্য নেই। আগে যেমন এ ক্ষমতাটা শুধু টিভির চ্যানেলগুলোর ছিল। এখন তার থেকেও দ্রুতগতিতে সব বদলে দিই আমরা। সারা বিশ্বের টুকরো টুকরো অংশ আমার আঙুলের চালাচালিতে এদিক ওদিক হয়ে যেতে পারে। আমরা সারাদিন ভাইরালের ঢেউয়ে আক্রান্ত। একটা ভাইরালের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই আরেকটা ভাইরাল হাজির। সমস্ত মনটা উপরের স্তর চাখতে চাখতে আঙুল দিয়ে ভিতরের স্তরের স্বাদ জিভ অবধি আনতেই পারছে না। কিছু যেন মিস হয়ে যাচ্ছে, কি একটা মিস হয়ে যাচ্ছে - কি একটা তাড়া!

      মেয়েটা মারা গেল। কিছু কিছু জায়গায় কিছু কিছু আন্দোলন কথাবার্তা হবে। তবে খুব বেশি কিছু হবে বলে মনে হয় না। আশঙ্কা হয়, হবে না-ই হয় তো। না হওয়ারই কথা। একটা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে সবাই তো ইতিমধ্যে যাচ্ছিই। আবার কেন? এগুলো দাগ কাটার আগেই দাগ তোলার জলের জোগাড় হয়ে থাকে। নইলে বাঁচে কি করে মানুষ!

      তবু মেয়েটা মারাই গেল। হয় তো বেঁচে থাকলেও পঙ্গু হয়ে থাকত। বাংলাদেশেও একটা ছবি খুব ঘুরছে। একই কারণ। একই ঘটনা। আসলে পুরো পৃথিবীটাই মেয়েদের জন্য নিরাপদ কোনোদিনই ছিল না, আজও নয়। এ কথা মেয়েদের থেকে আমরা পুরুষেরা আরো ভালো জানি। কি করে জানি তার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। আমরা জানি। আমাদের পরিবারের মেয়েরা সুরক্ষিত আছে, সে একটা ঘটনা। স্বাভাবিক ঘটনা। একটা মেয়ে কিছু মানুষের লালসার অত্যাচারে মারা গেছে, এও কোথাও একটা যেন স্বাভাবিক ঘটনা বলে মেনেই নিয়েছি, কাঙ্ক্ষিত ঘটনা হিসাবে নয় যদিও। আমরা বুঝে নিয়েছি আসলে পৃথিবী বর্বরতাশূন্য কোনোদিন হবে না। যদিও আবেগে চাইব, তাই হোক। কিন্তু প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখব, বুঝব, প্রকৃতি সভ্যতাকে চিরকালই এমনিই একটা আংশিক আবরণ হিসাবেই দেখবে, তার বর্বরতাকে সম্পূর্ণ ক্ষান্ত করতে পারে এমন ক্ষমতা মানুষ পাবে কি করে? সেকি প্রকৃতির বাইরে?

      তবু মেয়েটা মারাই গেল। আরো অনেক কিছু প্রতিদিন ইউপিতে হচ্ছে, কিন্তু কারোর সম্মুখ সমরে নাবার সাহস কোথায়? একি আড়াই ঘন্টার হিন্দি সিনেমা যে অন্তত একটা দয়ালু পরিচালক ও প্রযোজক পাওয়া যাবে, যে অন্তত দর্শকের সেন্টিমেন্টের দিকে তাকিয়ে প্রতিবাদীর সঙ্গে থাকবে, যে কিনা শেষে হিরোর তকমা পাবে? তা তো হবার নয়। এ যে রূঢ় বাস্তব ভূমি। বাস্তবতা। মহাকাব্য কি? না তো।

      কিন্তু বাস্তব রূঢ় জগতে সেন্টিমেন্ট শুকাতে কতক্ষণ লাগে? মুহূর্তের মধ্যে সব শুকনো খটখটে। বাকিটা থাকে ক্ষমতা আর উদ্ধত চোখ রাঙানির হাতে। সবাই ভয় পেয়ে যায়। অতিমাত্রিক বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষেরা নানা বিশ্লেষণে বুঝিয়ে দেয় এইটা আগেও অনেকবার হয়েছে, সামাজিক গঠন কিভাবে এর জন্য দায়ী, কি কি কার‍ণে এগুলো আমাদের মেনে নিতেই হবে, দুঃখের সঙ্গেই মেনে নিতে হবে। এমনকি যারা বলেন না, আপনার বাড়িতে হলে আপনি কি করতেন? কিচ্ছু না। দেখুন যাদের বাড়ির সাথে হয় তারাও অবশেষে মেনেই নেয়। কেউ কেউ লড়াই করে। কিন্তু অনেকেই লড়াইটার দিকে আর যায় না। মানুষের আয়ুষ্কাল আর লোভ, নীতি আর ন্যায়ের জন্য লড়াইয়ে সাথ দেয় না। বলে যেটুকু আছে সেটুকুকেও খুইয়ে বোসো না। তাই এ প্রশ্ন নিরর্থক, আপনার পরিবারের কেউ হলে কি হত? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিচ্ছু হয় না। সে আবার বাজারে যায়। জীবিকার জন্য রাস্তায় নামে। দীর্ঘশ্বাসকে আয়ুর সাথে সমঝোতা করিয়ে নেয়।

      তবু যে মেয়েটা মরেই গেল। তবু যে মেয়েটার লড়াইয়ের কথাটা কোনো খবরের কাগজে দীপিকা পাডুকোনের মাস্ক পরে গাড়ি থেকে নামার ছবিটা ছাপিয়ে গেল না। আমাদের তখনই তো বোঝা উচিত না, আমাদের গোটা দেশে একটা ইউপি প্রচ্ছন্ন ফল্গুধারার মত বয়েই চলে, বয়েই চলে। আমরা অপেক্ষা করি কোনো খবরের ঝাঁঝটা চড়া হওয়ার, মানবিক দিক থেকে না, বাজারি সেন্টিমেন্টের পাল্লায় মেপে।

      লেখাটা তো থামাতেই হবে। কারণ এই লেখাটার তো কোনো উদ্দেশ্য নেই। শুধুমাত্র আইসিউ-র সামনে দাঁড়ালাম, মাথাটা নীচু করে, এইটা জানানোর জন্য। শুধু এইটুকু বলার জন্য, আমিও পৃথিবীটাকে ভালোবাসি না। বাসি না। বাসি না। আমারও অনেক ঘেন্না। অনেক। অনেক। মনের বেশি গভীরে ঢুকে দেখো, আমিও অনেকগুলো শবদেহ আগলে বসে আছি। ছিন্নভিন্ন। লালসায়।